—ফাইল চিত্র।
খয়রাশোলের পাঁচড়ার প্রিয়ঙ্কা ও তন্ময় ঘোষের মাসতিনেকের শিশুপুত্র অরুণ জন্মের পর থেকেই কার্যত নির্জীব। সপ্তাহ দু’য়েক আগে ওই দম্পতি জানতে পারেন, ছেলের হৃদযন্ত্রের সমস্যা রয়েছে। সরকারি ‘শিশুসাথী’ প্রকল্পে নিখরচে অস্ত্রোপচারের জন্য কলকাতার হাসপাতালে ভর্তির দিনও ঠিক হয়েছিল। কিন্তু শেষবেলায় তা বাতিল হয়।
একই ভাবে ওই প্রকল্পে অস্ত্রোপচারের কথা ছিল নানুরের বছর দুয়েকের শিশুকন্যা লিলি খাতুনের। হৃদযন্ত্রে সমস্যা রয়েছে তারও। দিন ঠিক হয়ে যাওয়ায় জেলা স্বাস্থ্য দফতর থেকে সব কাগজপত্রও সংগ্রহ করেছিলেন লিলির বাবা রাজমিস্ত্রি মীর জের আলি। গত বৃহস্পতিবার মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় রওনা হতেন। তার আগেই তিনি জানতে পারেন— গিয়ে লাভ নেই, এখন কাজ কিছু হবে না।
সব ঠিক হওয়ার পরেও অসুস্থ শিশুদের অস্ত্রোপচার না হওয়ায় বিপাকে পড়েছে দু’টি পরিবার। শুধু লিলি বা অরুণ নয়, একই পরিস্থিতিতে বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার অন্তত তিরিশটি শিশুর পরিবার। ঠিক কোথায়, কবে ওই শিশুদের অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসা হবে, জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও তা স্পষ্ট করে বলতে পারেননি। জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, সমস্যার মূলে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সাম্প্রতিক একটি সিদ্ধান্ত।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, হৃদযন্ত্রের যে কোনও অস্ত্রোপচার বা চিকিৎসার জন্য ১ লক্ষ ১৫ হাজার থেকে ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সব খরচ বহন করে সরকার। সে জন্য স্বাস্থ্য দফতরের নির্দিষ্ট সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। কয়েক মাস কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল আমরিতেই জেলার শিশুদের অস্ত্রোপচার করা হতো। কিন্তু ১২ জুলাই থেকে সেই নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে। নির্দেশ এসেছে, আমরিতে পাঠানোর আগে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের দল ওই শিশুদের দেখবেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলে তবেই ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হবে কোনও শিশুটি।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, কিন্তু এনআরএস-এ কোন চিকিৎসকেরা শিশুদের দেখবেন সেটা স্পষ্ট নয়। ১২ জুলাইয়ের পরে থেকে যে সব শিশুকে এনআরএসে পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে কোন শিশু বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হবে বা কে হবে না— এনআরএস থেকে এখনও সে সংক্রান্ত কোনও বার্তা জেলাকে জানানো হয়নি। অস্ত্রোপচারের দিন পেয়েও যে ক্ষেত্রে এই জটিলতায় তা আটকে গিয়েছে, সেই শিশুদের কী হবে তা-ও জানা যায়নি।
বীরভূম স্বাস্থ্য দফতরের সিএমওএইচ হিমাদ্রি আড়ি বলছেন, ‘‘আমরিতে পাঠানোর আগে শিশুদের পরীক্ষা করার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হিসেবে এনআরএসকে ঠিক করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার এই নিয়ে বৈঠক রয়েছে। দ্রুত সমস্যা মিটবে বলে আশা করা যায়।’’
রাজ্যে যে সব শিশুদের হৃদযন্ত্রে সমস্যা রয়েছে, দ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন অথচ আর্থিক সঙ্গতির অভাবে তা করাতে পারছে না পরিবার— এমন ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের অগস্ট মাসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শিশুসাথী’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেন। যদিও ওই প্রকল্পের বড় অংশ বহন করে কেন্দ্রীয় সরকার। ‘রাষ্ট্রীয় বাল সুরক্ষা কার্যক্রম’ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি ব্লকে ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রয়েছে। যেখানে ১ থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যপরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। চিকিৎসকেরা বিভিন্ন স্কুল ও অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিবির করে এই প্রকল্পের আওতায় আসতে পারে এমন হৃদরোগ থাকা (কারও বাইপাস সার্জারি প্রয়োজন, কারও বা ভাল্ভ প্রতিস্থাপন বা অন্য কোনও অস্ত্রোপচার প্রয়োজন) শিশুদের চিহ্নিত করেন। শুধু শিবির নয়, সরকারি হাসপাতাল থেকেও চিহ্নিত শিশুরা এই প্রকল্পের সুযোগ পেতে পারে। এর পর জেলা স্বাস্থ্য দফতরে চিহ্নিত শিশুটির পরিবার আবেদন করলে, যে হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হবে সাত দিনের মধ্যে সেই হাসপাতালে ‘রেফার’ করা হয়।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, আগে বীরভূমে এমন অস্ত্রোপচারের জন্য শিশুদের পাঠানো হতো দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতালে। বর্তমানে কলকাতার আমরিতে। ২০১৩ সালে সরকারি ওই প্রকল্পের জন্যে হৃদযন্ত্রের সমস্যা থেকে মু্ক্তি পেয়েছে জেলার ১ হাজার ২০০ শিশু।
গোলমাল বেঁধেছে সম্প্রতি।
জেলা স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মনে করছেন, এমনিতেই সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার এবং কিছু ক্ষেত্রে দারিদ্রতার জন্য শিশু হৃদরোগে কষ্ট পেলেও সরকারি প্রকল্পের সুযোগ নিচ্ছিলেন না কিছু পরিবার। পড়শি জেলা থেকে অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা কলকাতায় ঠেলে দেওয়ায় অসুবিধা বেড়েছিলই। এ বার ব্যবস্থা আরও জটিল হওয়ায় অসুস্থ শিশুদের অভিভাবকদের উদ্বেগ বহু গুণ বাড়ল।
অরুণ ও লিলি খাতুনের বাবাদের কথাতেই তা স্পষ্ট। তন্ময়বাবু ও মির জান আলি বলছেন— ‘‘বাচ্চার কষ্ট দেখা যাচ্ছে না। দিন ঠিক হয়েও সব ভেস্তে গেল। কী করব বুঝতে পারছি না। জেলা স্বাস্থ্য দফতরও বলতে পারছে না কবে কী হবে।’’
স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘অনেক অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার হচ্ছিল বলেই আদৌ অসুস্থ শিশুদের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন রয়েছে কি না খতিয়ে দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চিকিতসকেরা।’’
উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা বলছেন, ‘‘সে সব ঠিক আছে। তবে আগে সব ব্যবস্থা পাকা করে সিদ্ধান্ত নিলে সমস্যায় পড়তে হতো না।’’