কার কবে দিন। নোটিস ঝুলছে বাপ্পার বাড়ির সামনে। (ডান দিকে) বাপ্পার বাড়িতে মেলা সেই ‘এফটিও’ ফাইল। ছবি:অনির্বাণ সেন।
গোটা কাণ্ডে প্রশ্নের মুখে পড়েছে তাঁদের ভূমিকাও। অথচ কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে সেই ব্লক প্রশাসনেরই অধীনে!
ষাটপলশা-কাণ্ডে তাই প্রশাসনের উপরে আস্থা দেখাতে পারছেন না বিরোধীরা। উল্টে গোটা ঘটনায় প্রায় সব মহল থেকেই উচ্চ পর্যায়ের দাবি আরও তীব্র হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টা আগেই এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছিলেন খোদ তৃণমূলের ময়ূরেশ্বর ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ধীরেন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার সেই দাবি তুললেন সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোমও। রবিবার তিনি বলেন, ‘‘ময়ূরেশ্বরে একশো দিনের প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে দলের স্থানীয় নেতারা আমাদের জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে দলের অন্দরে আলোচনা হয়েছে। শীঘ্রই ওই কাণ্ডের উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি জানিয়ে প্রশাসনকে স্মারকলিপি দেব।’’
ঘটনা হল, গত কয়েকদিন ধরেই জবকার্ড এবং ব্যাঙ্কের পাসবই আটকে রেখে মজুরদের ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ষাটপলশা পঞ্চায়েতের প্রায় প্রতিটি গ্রাম তেতে উঠেছে। প্রাপ্য টাকা ফেরতের দাবিতে একের পর এক সুপারভাইজার, পঞ্চায়েত সদস্য, এমনকী খোদ পঞ্চায়েতের প্রধানকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন জবকার্ডধারীরা। ক্ষোভের মুখে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাপ্পার বিরুদ্ধে কার্ড এবং পাসবই আটকে রাখার অভিযোগ শোনা গিয়েছে। ময়ূরেশ্বরের মনোহরপুর গ্রামের বাসিন্দা সুরথ মণ্ডল ওরফে বাপ্পা লাগোয়া বারগ্রামের বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ জটিল মণ্ডলের ডান হাত হিসাবে পরিচিত ময়ূরেশ্বর ২ ব্লক এলাকায় পরিচিত নাম। এলাকাবাসীর অভিযোগ, জটিলের নির্দেশেই মজুরদের পরিবর্তে জটিলেরই ট্রাক্টর ও মাটি কাটার যন্ত্র দিয়ে কাজ করে একশো দিনের প্রকল্পের সিংহভাগ টাকাই আত্মসাত করা হয়েছে। জবকার্ড ও পাসবই নিজেদের হেফাজতে রেখে বাপ্পার বাড়িতেই সমান্তরালে ব্যাঙ্ক ও পঞ্চায়েতের কাজ চালানো হতো বলে অভিযোগ। আন্দোলনকারীদের আরও দাবি, সুপারভাইজারদের মুখে নিজের নাম উঠে আসতেই রাতারাতি সেই অফিসের যাবতীয় পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলেছেন বাপ্পা। অথচ দিন পাঁচেক আগেও ওই বাড়ির সামনে ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বহু জবকার্ডধারী, সুপারভাইজার, পঞ্চায়েত সদস্যদের ভিড় লেগেই থাকত বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি।
এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ গিয়ে দেখা গেল বাপ্পার বাড়ির সামনে দু’জন মজুর ছাড়া কেউ কোথাও নেই। বাইরের লোকেদের যাতায়াতের জন্য উঠোন থেকেই সোজা দোতলা পর্যন্ত উঠে গিয়েছে সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই এগিয়ে এলেন বাপ্পার মা পূর্ণিমাদেবী। নিজেই পর পর তিনটি ঘর ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বললেন, ‘‘খবরের কাগজে আমার ছেলের সম্পর্কে কত মিথ্যা কথা লিখেছে দেখুন। এই ঘরে নাকি অফিস ছিল। আপনারই দেখুন ঘরে কিছু আছেন কিনা।’’ ঘরগুলিতে এ দিন সে রকম কিছু না মিললেও দেখা গেল একটি দেওয়াল আলমারিতে ধুলোর মাঝে সরিয়ে নেওয়া থাক থাক ফাইলের চিহ্ন। পরের ঘরেই পাশাপাশি দু’টি অফিস আলামারি। তার একটিতে সবে ঢোকানো কিছু বিছানাপত্র। একটি ঘরে সেন্টার টেবিলে এক দিকে সিংহাসন আকৃতির একটি চেয়ার। সর্বত্রই নিপুণ ভাবে কিছু যেন একটা লুকিয়ে ফেলার ছাপ স্পষ্ট।
তারই মাঝে একটি ঘরে সানশেডের উপরে মিলল একটি ফাইল। হলুদ রঙের সেই ফাইলের উপর চেটানো কাগজের উপর লেখা রয়েছে ‘ব্লক এফটিও পেমেন্ট কমপ্লিট’। ওই ফাইল সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই মেজাজ হারিয়ে ফেলেন মধ্যবয়সী পূর্ণিমাদেবী। সাফ জানিয়ে দেন, ‘‘বাড়িতে স্বামী–ছেলে কেউ নেই। আমি একা মহিলা রয়েছি। এখনই বেরিয়ে যান। চলে না গেলে ফাঁসিয়ে দেব।’’ ইঙ্গিত বুঝে অগত্যা দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নামতে হল নীচে। বাড়ির সামনে তখনও একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে সাঁটানো রয়েছে ছাপানো সেই কাগজ। যাতে লেখা, কোন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের দেখা করার দিন কবে।
এ দিকে ওই ফাইল পাওয়ার পরেই আরও বেশি করে প্রশ্নের মুখে ব্লক প্রশাসনের ভূমিকা। কারণ, পঞ্চায়েত ছাড়িয়ে ব্লক পর্যন্ত বাপ্পার লম্বা হাতের ইঙ্গিত রয়েছে ওই ফাইলেই। ‘এফটিও’ অর্থ ‘ফান্ড ট্রান্সফার অর্ডার’। ১০০ দিন কাজে মাস্টাররোল হয়ে যাওয়ার পরে রাজ্য সরকার যখন ওই তহবিলে টাকা জমা করে, তখন নিদিষ্ট পাসওয়ার্ডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট খুলে পঞ্চায়েত কর্মীরা তা সরাসরি জবকার্ডধারীদের পাসবইয়ে ঢুকিয়ে দেন। ব্লক স্তরেও একই ভাবে টাকা ঢোকানো হয়। প্রশ্ন উঠছে, বাপ্পার বাড়িতে ওই ফাইল এল কী করে? তা হলে কি বাপ্পা ব্লকে ওই ফাইল করে মজুরদের বেতনের তালিকা নিয়ে গিয়ে এফটিও করিয়ে এসেছেন? নাকি ব্লকের আধিকারিকেরাই ল্যাপটপ-কম্পিউটার নিয়ে এসে বাপ্পার বাড়িতেই ওই কাজ করে দিয়ে গিয়েছেন? স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, শুধু সুপারভাইজার কিংবা জবকার্ডধারীরাই নন, রাতের অন্ধকারে গাড়ি হাঁকিয়ে বাপ্পার কাছে আসতে দেখা গিয়েছে বহু সরকারি কর্মীকেও।
জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর সঙ্গে এ দিন যোগাযোগ করা যায়নি। অভিযোগ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি জেলার ভারপ্রাপ্ত নোডাল অফিসার বিশ্বরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ও। তবে বিডিও (ময়ূরেশ্বর ১) সৈয়দ মাসুদুর রহমানের বক্তব্য, তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। পঞ্চায়েত বা ব্লক স্তরের কোনও আধিকারিকের জড়িত থাকলে তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। অন্য দিকে, অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উমাশঙ্কর এস বলেছেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। তবে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বিষয়টি তদন্ত করতে ইতিমধ্যেই বিডিও-কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পরেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এ দিকে, এ দিনই ১০০ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ওই পঞ্চায়েতেরই বাসুদেবপুরের ৮০ জন তৃণমূল সমর্থক দলে যোগ দিয়েছেন বলে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্বের দাবি। কোটাসুরে দলীয় কার্যালয়ে তাঁদের হাতে পতাকা তুলে দেন দলের ময়ূরেশ্বর ২ নং ব্লক মণ্ডল কমিটির সহ-সভাপতি কিরীটিভূষণ মণ্ডল। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এর আগেও আমরা ওই পঞ্চায়েতে যন্ত্র দিয়ে কাজ করানোর লিখিত অভিযোগ করেছিলাম। কিন্তু, কোনও কাজ হয়নি। এখন সংবাদমাধ্যমে এত লেখালিখির পরেও প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে। আসলে তথ্য প্রমাণ লোপাটের সুযোগ করে দিচ্ছে। কারণ, তা না হলে গোটা ঘটনায় তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে সরকারি কর্মী-আধিকারিকদের যোগসাজসের প্রমাণ মিলে যেতে পারে।’’