পেনশনের বাড়তি টাকা কলেজে দান

পারিবারিক ব্যবসা তাঁকে টানেনি। বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। তাই কখনও দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রেখে, বছরের পর বছর পড়িয়েছেন। কখনও অবসরের পরে কলেজে গিয়ে কয়েক বছর বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের সেই অবসরপ্রাপ্ত গণিতের অধ্যাপক পঙ্কজকুমার ঘোষ এ বার নিজের পেনশনের বাড়তি এক লক্ষ টাকা দুঃস্থ পড়ুয়াদের বই কিনে দেওয়ার জন্য কলেজকে দান করলেন।

Advertisement

অরুণ মুখোপাধ্যায়

সিউড়ি শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৫ ০১:১৩
Share:

বাড়িতে স্ত্রীর সঙ্গে পঙ্কজকুমার ঘোষ। —নিজস্ব চিত্র।

পারিবারিক ব্যবসা তাঁকে টানেনি। বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা। তাই কখনও দুঃস্থ মেধাবী ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রেখে, বছরের পর বছর পড়িয়েছেন। কখনও অবসরের পরে কলেজে গিয়ে কয়েক বছর বিনা বেতনে পড়িয়েছেন। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের সেই অবসরপ্রাপ্ত গণিতের অধ্যাপক পঙ্কজকুমার ঘোষ এ বার নিজের পেনশনের বাড়তি এক লক্ষ টাকা দুঃস্থ পড়ুয়াদের বই কিনে দেওয়ার জন্য কলেজকে দান করলেন।

Advertisement

বয়স ৮৫ পেরিয়েছে। কিন্তু পঙ্কজবাবুর শিক্ষানুরাগী মন এখনও তরুণ। তাই ছাত্রছাত্রীদের জন্য এখনও ভাবেন। এখনও নিজের কলেজের জন্যে সেই আগের মতোই টান অনুভব করেন। আদতে তিনি শ্রীরামপুর শহরের বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়িক পরিবারের সদস্য। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে তিনি গণিতে অধ্যাপনা করেন। সেই সময়ে কোনও দুঃস্থ পরিবারের ছেলে টাকার অভাবে পড়তে পারছে না জানতে পারলে পঙ্কজবাবু ছাত্রটিকে নিজের বাড়িতে রেখে পড়িয়ে গিয়েছেন।

অবসরের পরেও তাই নিজেকে ছাত্র-ছাত্রীদের থেকে দূরে রাখতে পারেননি এই শিক্ষানুরাগী মানুষটি। অবসরের পরে কিছু দিন তিনি সিউড়ি কালিগতি নারী শিক্ষা বিদ্যায়তনে অতিথি শিক্ষক পড়িয়েছেন। সে বাবদ যে ৩০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন, সেই টাকাও তিনি বাড়িতে নিয়ে যাননি। সমস্ত টাকাই সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের গণিত বিভাগে দান করেছিলেন। এ বার পেনশনের বাড়তি টাকাটাও কলেজকেই দিলেন। তিনি বলেন, “কত দুঃস্থ ছাত্রছাত্রী প্রয়োজনীয় বই কিনতে পারে না। এ জন্য তাদের খুবই অসুবিধা হয়। অথচ কলেজের বই-ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত বইও নেই। যদি আমার টাকা সেই কাজে ব্যবহার হয়, তাতে আমারই খুব ভাল লাগবে।”

Advertisement

কলেজ থেকে সরকারি ভাবে অবসর নিলেও কলেজের সঙ্গে নিজেকে আলাদা করতে পারেন না তিনি। সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে বিভাগীয় অধ্যাপকের অভাব রয়েছে শুনে নিজে টানা পাঁচ বছর ওই কলেজে মাত্র এক কাপ চা এবং মাসিক এক টাকা নিয়ে ক্লাস করিয়েছেন। তাঁর সম্পর্কে এমনই নানা কথা ছড়িয়ে রয়েছে এই কলেজে। তাই কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ লক্ষ্মীনারায়ণ মণ্ডল বলেন, ‘‘মানুষটা কলেজ-অন্ত প্রাণ। ছাত্রদের সঙ্গে তিনি নিয়মিত ফুটবল খেলতেন। ওই ছাত্র-দরদি মানুষ এখন বিরল।” পঙ্কজবাবু সম্পর্কে বলতে গিয়ে ওই কলেজের অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপক তপন চৌধুরী বলেন, ‘‘দুঃস্থ ছাত্রদের নিজের বাড়িতে রেখে ক’জন শিক্ষক উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করেন? এত বড়মনের মানুষ ক’জন আছেন?’’

একই কথা তাঁর বাড়িতে পড়াশোনা করে যাওয়া সিউড়ি বেনিমাধব হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শিশির দাস বৈরাগ্যের মুখেও। তিনি বলেন, ‘‘পঙ্কজবাবু শুধু আমার গুরুদেবই নন, বাবার মতো। গরিব বলে পড়াশোনা অনিশ্চয় হয়ে পড়েছিল। সে সময় পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন উনি। তাঁর বাড়িতে রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। তাঁর স্ত্রী মনিকাদেবীও আমাদের সবকিছু মায়ের মতো নজরে রাখতেন।’’

পঙ্কজবাবুর বাড়িতে থেকে হারাধন দত্ত ও সইবুল ইসলাম এক সঙ্গে থেকে পড়াশোনা করেছেন। এখনও তাঁরা তাঁদের ‘স্যর’কে ছাড়তে পারেননি। দু’জনেই ওই বাড়িতে থেকে প্রাইভেট টিউশন করেন। পঙ্কজবাবুর বলেন, “আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তাঁরা কলকাতায় থাকে। এখন এদের নিয়েই বেঁচে আছি।’’ পাশে পেয়েছেন স্ত্রীকেও। মনিকাদেবীর কথাতেই তা স্পষ্ট। হাসতে হাসতে তিনি বলেন, “ও একটা পাগল মানুষ। তবে ওর পাগলামিটাকেও আমার ভাল লাগে।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement