বিশ্বজিৎ দে (বাঁ দিকে), গৌরব দাশ (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র।
হাইড্রোজেল এবং ম্যাগনেসিয়াম— এই দুয়ের মেলবন্ধনে একটি অত্যন্ত মূল্যবান রাসায়নিকের সন্ধান মিলেছে যা স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে বলে অনুমান। ‘ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোজেল’ বা ‘মেটালো-হাইড্রোজেল’ নামে ওই রাসায়নিকের সন্ধান দিয়েছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দে-র নেতৃত্বাধীন একটি গবেষক দল।
জানা গিয়েছে, সন্ধানপ্রাপ্ত রাসায়নিকটি নিয়ে ইতিমধ্যেই গবেষণা চালিয়েছেন কলকাতার চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানী গৌরব দাশ এবং তাঁর ছাত্র দেবজিৎ তালুকদার। অত্যন্ত ইতিবাচক ফল মিলেছে। তাঁরা ওই রাসায়নিক প্রয়োগ করেছিলেন ক্যানসার সেল লাইন-এ। দেখা গিয়েছে, সেটি ক্যানসার কোষে অ্যাপোপটোসিস নামে প্রক্রিয়াকে প্ররোচিত করে, যা কোষ মৃত্যুর প্রাকৃতিক বা জৈবিক প্রক্রিয়া বলে পরিচিত। এই গবেষণাটি আমেরিকার রাসায়নিক সোসাইটি স্বীকৃতি দিয়েছে এবং বিখ্যাত ওই সোসাইটির ‘ল্যাংমুইর’ নামে জার্নালে সেটি প্রকাশিত হয়েছে।
হাইড্রোজেল, এককথায় একটি স্থিতিস্থাপক বস্তু যা জলকে নির্দিষ্ট এক আকৃতির মধ্যে আবদ্ধ রাখে। ম্যাগনেসিয়াম হল অতীব প্রয়োজনীয় একটি মৌল। এই দুয়ের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা ‘ম্যাগনেসিয়াম হাইড্রোজেল’ স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা নেবে বলে আশাবাদী বিশ্বভারতীর অধ্যাপক বিশ্বজিৎ দে ও তাঁর গবেষক ছাত্রছাত্রী ইন্দ্রজিৎ পাল, শান্তনু মজুমদার, জেরাল্ড লেপচা, দেবলীনা সাহা ও শুভজয় সাধু। বিশ্বজিৎ বলেন, “জল-সমৃদ্ধ বস্তুটির মধ্যে ক্ষত হলে সময়ের সঙ্গে ফের জুড়ে গিয়ে আগের মতো অবিকল রূপ দিতে সক্ষম।” এ কাজে তাঁরা আইআইটি ধানবাদের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের অধ্যাপক সুরেশকুমার আতিরাজুলা-র সহযোগিতা পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন বিশ্বভারতীর ওই অধ্যাপক।
গৌরব দাস জানান, “যে আরওএস বা রিঅ্যাকটিভ অক্সিজেন স্পিসিজ়-কে নিরপেক্ষ করার জন্য সাধারণ কোষে বিভিন্ন উৎসেচক তৈরি হয়।
কিন্তু ক্যানসার কোষে ওই উৎসেচকগুলির যথাযথ কাজ করতে পারে না। তাই তারা অ্যাপোপটোসিস বা কোষের মৃত্যু ঘটাতেও সক্ষম নয়। সেক্ষেত্রে মেটালো-হাইড্রোজেল ব্যবহার করে রসের বৃদ্ধি করলে তা কোষকে অ্যাপোপটোসিসের দিকে ঠেলে দেয়।”
কী ভাবে, বিজ্ঞানম্মত বিষয়টি একটু সহজে ব্যাখা দিয়েছেন তাঁরা। সেই ব্যাখ্যা অনুয়ায়ী, যে অক্সিজেন বায়ু থেকে নেওয়া হয় সেটি ‘নিউট্রাল’ বা নিরপেক্ষ কোনও প্রতিক্রিয়া দেয় না বা জৈবিক ক্রিয়া করার ক্ষমতা থাকে না। কিন্তু শরীরে সারাক্ষণ রিঅ্যাকশন বা রাসায়নিক ক্রিয়া হয়েই চলেছে। নানা জৈবিক ক্রিয়ার ফলে প্রচণ্ড বিক্রিয়া করার প্রবণতা সম্পন্ন প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতি তৈরি হয়। যেগুলিকে ‘রস’ আরওএস বা বলে।
সাধারণ ভাবে ওই ধরনের প্রচণ্ড বিক্রিয়া করার প্রবণতা সম্পন্ন ‘রস’ যদি শরীরে জমতে থাকে তা হলে, কোষের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ডিএনএ-র কেমিক্যাল বন্ড। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলিকে মেরামত করার জন্য স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া রয়েছে। কোষের মধ্যে বেশ কিছু উৎসেচক তৈরি হয়। তাতেই ৮০-৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত কোষ মেরামত সম্ভব। অন্যথায় অপ্রয়োজনীয় কোষের স্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। যা ‘অ্যাপোপটোসিস’ নামে পরিচিত।
বিশ্বভারতী ও ক্যানসার হাসপাতালের গবেষকেরা জানান, ক্যানসার হলে উপরোক্ত প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ ভাবে ব্যহত হয়। ক্যানসার কোষে উৎসেচকগুলির কাজ শুধু ব্যহতই হয় না, কোষের স্বাভাবিক মৃত্যুর পথও বন্ধ হয়ে যায়। যাতে ক্যানসার কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে।
ঠিক এখানেই বিশ্বভারতীর গবেষক দলের আবিষ্কৃত ‘মেটালো-হাইড্রোজেল’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে বলে বিশ্বাস। কারণ ওই রাসায়নিক প্রয়োগে ক্যানসার কোষে আরওএস বা প্রতিক্রিয়াশীল অক্সিজেন প্রজাতির পরিমাণ বৃদ্ধি ঘটে। ক্যানসার কোষের মৃত্যু বা অ্যাপোপটোসিস ঘটায় যা ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে।
গৌরব দাশ ও তার ছাত্র দেবজিৎ তালুকদারের মতে, এই গবেষণাটি ভবিষ্যতে স্তন ক্যানসার বিরোধী থেরাপিউটিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এরপর তাঁরা গবেষণাটি ইঁদুরের দেহে পরীক্ষা করার কথাও ভেবেছেন।