থোড়াই কেয়ার! হাসপাতাল মোড়ে মাঝপথে বাঁক নিচ্ছে টোটো।
জাতীয় সড়কের ধারে রামপুরহাট হাসপাতাল পাড়া এলাকা। দুর্ঘটনাপ্রবণ বলে সম্প্রতি সেখানে রাস্তায় ডিভাইডার তৈরি করা হয়েছে। শনিবার বেলা তখন ১১টা। ব্যস্ত সময়ে সড়ক দিয়ে নলহাটির দিকে ছুটে চলেছে রায়গঞ্জগামী একটি সরকারি বাস। হঠাৎ সজোরে ব্রেক কষলেন চালক। হুড়মুড়িয়ে পড়লেন যাত্রীরা। পথ চলতি মানুষজনও হইহই করে উঠলেন। একটি টোটো। বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে লাগতে এক চুলের জন্য রক্ষা পেল। এ রকম, পরিস্থিতিতে যেমনটা হয়— দুই চালকের এক প্রস্ত উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি। পাঁচ মিনিটের বিরতি। তারপরে একই জায়গায় ফের একই ঘটনা। এ বারে লরি এবং টোটো।
শুক্রবার সকালের দুর্ঘটনার পরেও এখনও আতঙ্কের রেশ কাটেনি রামপুরহাটে। বসাস্ট্যান্ডের অদূরে টোটোর ধাক্কায় সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে ট্রাকের চাকা পিষে যায় আলিমউদ্দিন শেখ নামে এক বালক। কিন্তু শনিবার দিনভর শহর জুড়ে টোটোচালকদের টনক নড়ার কোনও নজিরই দেখা গেল না। আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধে চলল টোটোর দৌরাত্ম্য।
সেই বাসস্ট্যান্ড এলাকা। শনিবারও নেই কোনও পুলিশি নজরদারি। জাতীয় সড়কে টোটো চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু যাত্রী তোলার রেষারেষি করতে করতে ছুটছে বেপরওয়া টোটো। দুর্ঘটনা যেখানে ঘটেছিল সেখানেও টোটো দাঁড় করিয়ে চলছে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা, হাঁকাহাঁকি। জিজ্ঞাসা করায় মকবুল শেখ নামে এক চালক বললেন, ‘‘সবাই তো চালাচ্ছে জাতীয় সড়ক দিয়ে। আমি একা বন্ধ করলে হবেটা কী!’’
এই দোহাই দিয়ে শহর জুড়ে চলছে নিয়ম ভাঙা। রামপুরহাট হাসপাতাল গেটের সামনে মহকুমা প্রশাসন বোর্ড টাঙিয়ে নির্দেশ দিয়েছে টোটো বা অন্য কোনও যানবাহন রাখা যাবে না। বোর্ড থেকে একটু দূরেই ফুটপাথ দখল করে গজিয়ে উঠেছে ‘টোটো স্ট্যান্ড’। প্লাস্টিকের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা টোটোর লাইন ঠিক করছিলেন মাঝবয়সি এক ব্যক্তি। বোর্ডের কথা বলতেই খাপ্পা হয়ে উঠলেন। তাঁর দাবি, ‘‘বোর্ড অনেক দূরে। সব ঠিক আছে।’’ স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ মনে করান, মাস ছয়েক আগে ওই জায়গাতেই টোটো চালকদের সঙ্গে স্থানীয় এক দোকানদারের হাতাহাতি হয়েছিল। কয়েক দিন পরেই দু’টি পৃথক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল এক সাইকেল আরোহী এবং মোটরবাইক চালকের। দুর্ঘটনার জন্য জাতীয় সড়ক দিয়ে টোটো চলাচলকে দায়ি করে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, কাজের কাজ যে কিছু হয়নি, তার প্রমাণ জাতীয় সড়কের উপরে শুক্রবারের দুর্ঘটনা।
দেশবন্ধু রোডে দু’’মুখেই টোটো।
টোটোর দৌরাত্ম্যের আরও অনেক নমুনা এ দিন দেখা গিয়েছে শহর জুড়ে। জাতীয় সড়কে পুরু করে সাদা দাগ টেনে দেওয়া থাকে। দাগের বাইরে দিয়ে পথচারিদের হাঁটেন। সেই গণ্ডি কোনও গাড়ি পার হতে পারে না। হাসপাতালের সামনে থেকে জাতীয় সড়ক ধরে ভাঁড়শালাপাড়া মোড় পর্যন্ত যাওয়ার সময়ে চোখে পড়ল, সাদা দাগের তোয়াক্কা করছেন না অধিকাংশ টোটো চালকই। জাতীয় সড়কের উপরেই টোটো দাঁড় করিয়ে রেখে যাত্রীর অপেক্ষা করছেন কেউ কেউ। যাত্রীর দখল নিয়ে চলছে বচসাও। স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের দাবি, এই ছবিটা নিত্যদিনের। এমনকী ঝামেলার জেরে পিছন থেকে আসা গাড়িঘোড়া দাঁড়িয়ে পড়লেও নাকি ভ্রুক্ষেপ করেন না চালকেরা।
টোটোর দাপট শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড় ভাঁড়শালাপাড়া এলাকাতেও। সেখানে চৌরাস্তায় টোটোর লাইন আর ফুটপাথ দখল করে গজিয়ে ওঠা বাজারের মধ্যে দিয়ে হাঁটা বেশ ঝকমারি কাজ। এ দিকে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের নির্দেশ কানেই তুলছেন না টোটো চালকদের একটা বড় অংশ। ইচ্ছে মতো অন্যগাড়িকে পাশ কাটিয়ে, ফাঁক দিয়ে গলে মর্জি মাফিক টোটো ছুটে চলেছে দুনিগ্রাম, লোটাস প্রেস বা হাসপাতালপাড়ার দিকে।
শহরের চালকেরা সমস্ত দায় চাপাতে চেয়েছেন বিভিন্ন গ্রামের টোটো চালকদের উপরে। তাঁদের দাবি, গ্রাম থেকে শহরে যাতায়াত করে যে টোটোগুলি, তারাই জাতীয় সড়ক দিয়ে বেপরোয়া ভাবে চলাচল করে। কিন্তু খাস শহরেও যে নিয়ম মানা হয়, তার প্রমাণ এ দিন মেলেনি। নিয়ম মাফিক, দেশবন্ধু রোড ওয়ান ওয়ে। টোটো চলাচল করার কথা ব্যাঙ্ক রোড দিয়ে। ডাকবাংলো মোড় থেকে ধুলাডাঙা মোড় হয়ে কোনও টোটো যেতে পারবে না। সেই সমস্ত আইন খাতায় কলমে আর বিজ্ঞপ্তিতেই রয়েছে। ছোট ছোট গলি দিয়েও ছুটছে টোটো। শহরের বাসিন্দা বাদল মণ্ডল, শ্যামল মজুমদারদের অভিযোগ, ‘‘দিনের ব্যস্ত সময়ে অলিগলি, মূল রাস্তা— সর্বত্রই চলাচল করা মুশকিল হয়ে পড়ে। প্রায়ই অফিসযাত্রীদের দেরি হয়ে যায় পথে। ঠিক সময়ে স্কুলে যেতে পারে না পড়ুয়ারা।’’
রামপুরহাটের তৃণমূল পুরপ্রধান অশ্বিনী তিওয়ারি এ দিন জানিয়েছেন, শহরের টোটো চালকদের নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠকে বসা হবে। এই পরিস্থিতিতে টোটোর জন্য রুট নির্দিষ্ট করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।