পুজো মিটলেই হারিয়ে যান ‘রাবণ-কাটা’ শিল্পীরা

গোটা গায়ে বড় বড় লোম। সাদা, কালো, কারও বা লাল। মুখে রাক্ষস-খোক্কসের মুখোশ। ডঙ্কা বাজিয়ে নাচতে নাচতে শহরের অলিগলি কাঁপিয়ে তুলছে কয়েক জন। শহরের বাসিন্দারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০১:০৯
Share:

বিষ্ণুপুরের পথে নাচের দল। বুধবার তোলা নিজস্ব চিত্র।

গোটা গায়ে বড় বড় লোম। সাদা, কালো, কারও বা লাল। মুখে রাক্ষস-খোক্কসের মুখোশ। ডঙ্কা বাজিয়ে নাচতে নাচতে শহরের অলিগলি কাঁপিয়ে তুলছে কয়েক জন। শহরের বাসিন্দারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছেন। বাবা, মা, দাদু বা ঠাকুমার কোলে চড়ে সেই নাচ দেখতে দেখতে ভয়ে মুখ গুঁজে ফেলছে খোকা-খুকুরা। মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুরবাসীর পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার মন খারাপ অনেকটাই কেটে যায় এই নাচের তালে। যার পোশাকি নাম ‘রাবণ কাটা’।

Advertisement

শহরের ইতিহাসবিদ চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত জানান, প্রায় তিনশো বছরের পুরনো এই নাচের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মল্ল রাজাদের স্মৃতি। সপ্তদশ শতকে মল্লরাজাদের তৈরি রঘুনাথজিউ মন্দিরে এই নাচ হত। তাঁদের উত্তরপুরুষেরা এখন রোজগারের জন্য শহর জুড়ে হনুমান, সুগ্রীব, বিভীষণ ও জাম্বুবানের সাজে সেজে রাবণ কাটা নাচ করেন। নাচের পটভূমি হল, রাবণ নিধনের পরে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস।

বাদ্যকর এবং নৃত্য শিল্পী মিলিয়ে জনা দশেক সদস্য থাকেন নাচের দলে। মূখ্য নৃত্যশিল্পী থাকেন চার জন। দু’জন সাদা পোশাকে হনুমান ও সুগ্রীব সাজেন। এক জন লাল পোশাক পরে সাজেন বিভীষণ। অন্য জন জাম্বুবান। পরনে কালো পোশাক। এ ছাড়াও দলে থাকেন ঝাড়খণ্ডি তালবাদ্য নাকাড়া, টিকারা, কাঁশি বা ঝাঁঝ বাজানোর শিল্পীরা। দশমী থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত এই নাচে মজে থাকে শহর।

Advertisement

কিন্তু ওই দ্বাদশী পর্যন্তই। তার পরে প্রাচীন এই শিল্পকে এখনও জিইয়ে রাখা শিল্পীরা পুজোর রোশনাইয়ের মতোই মিলিয়ে যান। রুজির টানে তাঁদের ফিরে যেতে হয় নিজের নিজের পেশায়। পরের পুজো পর্যন্ত তাঁদের খবর আর কেউ রাখে না। রাবন কাটা নাচের শিল্পীদের আক্ষেপ, তাঁরা এখনও প্রশাসনের দৃষ্টির বাইরে রয়ে গিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের প্রাচীন লোকশিল্পগুলিকে বাঁচাতে নানা প্রকল্প চালু করেছেন। বাউলশিল্পী, আদিবাসী নৃত্যশিল্পী, পুতুল নাচের শিল্পীরা সেই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। সরকারি প্রকল্পের প্রচার করে নিয়মিত রোজগার করছেন ওই শিল্পীরা। মাসের শেষে মিলছে সরকারি ভাতাও। কিন্তু বংশ পরম্পরায় রাবণ কাটা নাচকে ধরে রাখলেও সেই সুযোগ মিলছে না এই শিল্পীদের।

নাচের দলে হনুমান সাজেন প্রধান শিল্পী সুকুমার অধিকারী। সংসার টানতে আইসক্রিম বিক্রি করতে হয় তাঁকে। বিভীষণ সাজেন রঞ্জিত গড়াই। তিনি সব্জি বিক্রেতা। জাম্বুবান সেজে আপাতত অলিগলি দাপিয়ে চলেছেন যিনি, দিন কয়েক পরে পেটের টানে চুন বিক্রি করে ফিরবেন সেই নারাণ বারিক। সুগ্রীবের সাজ ছেড়ে রাজমিস্ত্রী মিঠুন লোহার ফিরে যাবেন শহর ফুঁড়ে ওঠা কোনও নতুন বাড়িতে ইট গাঁথতে।

শিল্পী সুকুমারবাবু বলেন, “এই নাচ মল্লরাজাদের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। প্রতি বছর দেশ বিদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ বিষ্ণুপুরে আসেন। প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে তাঁদের সামনে এই নাচ তুলে ধরার বন্দোবস্ত করলে পর্যটকেরা আরও ভাল ভাবে এখানকার ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে জানতে পারতেন। আমাদেরও একটু আয়ের উপায় হতো।’’ শিল্পী রঞ্জিতবাবু আক্ষেপ, “লোকশিল্পী হিসেবে সরকারি ভাতা পেতে তথ্য সংস্কৃতি দফতরে আবেদন করেছি বহু দিন আগে। কিন্তু এখনও আমাদের শিল্পী পরিচয়পত্রটাই দেওয়া হয়নি।”

রাবণ কাটা নাচের শিল্পীরা জানান, এক কালে বিষ্ণুপুর মেলায় তাঁদের ধরাবাঁধা অনুষ্ঠান থাকত। তবে গত দু’বছর ধরে সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বিষ্ণুপুর মেলার শোভাযাত্রায় সামিল হওয়ার জন্য ডাক পড়ে তাঁদের। প্রত্যেককে একশো টাকা করে দেওয়া হয় তার জন্য। তাঁরা জানান, নিয়মিত ভাতার দাবিতে কয়েক বছর আগে বিষ্ণুপুর পুরসভায় আবেদন জানানো হয়েছিল। তার প্রেক্ষিতে বছরে সামান্য কিছু সাহায্য পুরসভা তাঁদের দিয়ে আসছে। এ ছাড়া অবরে সবরে কিছু প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে ডাক আসে। কিন্তু ওইটুকুই। শিল্পীদের অভিযোগ, প্রাচীন এই শিল্পের প্রসারে সে ভাবে কখনওই পদক্ষেপ করতে দেখা যায়নি জেলা প্রশাসনকে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের প্রচারে যাতে তাঁদের সামিল করা হয় সেই দাবি তুলেছেন তাঁরা।

এই শিল্পীরা কেন বঞ্চিত রয়ে গিয়েছেন সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি প্রশাসনের পক্ষ থেকেও। তবে বাঁকুড়া জেলা শাসক মৌমিতা গোদারা বসু আশ্বাস দিয়েছেন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা শোনা হবে। জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “ওই শিল্পীরা যাতে শিল্পী পরিচয়পত্র ও সরকারি প্রকল্পের প্রচার করার সুযোগ পান তার জন্য আমি জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলব।” এ বারের বিষ্ণুপুর মেলায় রাবনকাটা নাচকে ফের তুলে ধরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্য।

এই সমস্ত আশ্বাসে আদৌ তাঁদের জীবনের অন্ধকার দূর হয় কি না সে দিকেই আপাতত তাকিয়ে শিল্পীরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement