বহুতলে বৃষ্টির জমা জলেও এডিসের লার্ভা। ছবি: সুজিত মাহাতো
দেশবন্ধু রোডে লাফিয়ে লাফিয়ে ডেঙ্গি রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কী কারণ, তা জানতে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছে পুরুলিয়া জেলা স্বাস্থ্য দফতর ও পুরসভা। রবিবার নতুন করে ডেঙ্গি রোগীর খোঁজ না মিললেও চারপাশে জমা জলে ডেঙ্গির জন্য দায়ী এডিসের লার্ভা দেখতে পেয়েছেন স্বাস্থ আধিকারিকেরা। তাঁদের বক্তব্য, এত ডেঙ্গি আক্রান্ত দেখেও হুঁশ ফিরছে না অনেকের।
গত কয়েক বছর ধরে পুরুলিয়া শহরে ডেঙ্গির প্রকোশ দেখা দিয়েছে। এ বছরও জেলায় এখনও পর্যন্ত ১৮ জনের ডেঙ্গি ধরা পড়েছে। তার মধ্যে ১৭ জনই পুরুলিয়া শহরের একই এলাকার বাসিন্দা। শুধু ওই এলাকাতেই কেন এত ডেঙ্গির প্রকোপ, তা নিয়ে প্রশ্ন ঘুরছে বিভিন্ন মহলে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত মরসুমে শহরে ডেঙ্গি ধরা পড়েছিল ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডে। এ বার সেই এলাকা থেকে অনেকটা দূরে দেশবন্ধু রোডের ১ ও ২১ নম্বর ওয়ার্ডে ডেঙ্গির প্রকোপ ছড়িয়েছে। তা হলে এখানে ডেঙ্গির সূত্রপাত কী ভাবে? রোগ মোকাবিলার পাশাপাশি এই প্রশ্নেরও উত্তর খুঁজতে তদন্তে নেমে পড়েছে স্বাস্থ্য দফতর।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের মহামারী বিশেষজ্ঞ সতীনাথ ভুঁইয়া বলেন, ‘‘কেন একই সঙ্গে একই জায়গায় এত জন আক্রান্ত হলেন, তা আমাদের ভাবাচ্ছে। প্রাথমিক তদন্ত আমাদের মনে হয়েছে, ডেঙ্গির জীবাণু বাইরে থেকে এসেছে।’’ জেলা স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিক জানান, ওই এলাকার আশপাশে একাধিক জায়গায় বহুতল তৈরির কাজ চলছে। সেখানে অন্য জেলা থেকে রাজমিস্ত্রিরা এসে কাজ করছেন। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে তাঁরা জানতে পেরেছেন, ওই জেলায় বেশ কিছুদিন আগে থেকে ডেঙ্গি ছড়িয়েছে। নির্মাণ শ্রমিকদের মধ্যে তিন জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন। তবে তাঁরা এখন বাড়িতে গিয়েছেন। তবে এই এলাকায় যে ভাবে লোকজন বাড়ির আশপাশে জমা জলে এডিসের লার্ভা কিলবিল করতে দেখেও তা না ফেলে রেখে দিয়েছেন, তাও এই রোগ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হতে পারে।
জেলা স্বাস্থ্য দফতরের পতঙ্গ বিশারদ সঙ্কর্ষণ রায় জানান, অন্য মশার সঙ্গে ডেঙ্গির জীবাণু বাহক এডিস মশার চরিত্রগত কিছু পার্থক্য রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘অন্য মশা শরীরে বসলে হুল ফুটিয়ে রক্ত খেয়ে উড়ে যাওয়ার পরে শরীরে জ্বালা অনুভব হয়। কিন্তু এডিস মশা শরীরে বসা মাত্রই জ্বালা অনুভূত হয়। ফলে তাদের পেট ভরে না। তাই পেট ভরাতে এডিস অন্তত পাঁচ জনের দেহ থেকে রক্ত শোষণ করে। তাই রোগও বেশি করে ছড়ায়। পরিষ্কার জল পেলেই এডিস ডিম পাড়ে। এখন বৃষ্টি হওয়ায় সর্বত্রই পরিষ্কার জল পাওয়ায় এডিসের ডিম পাড়ার আদর্শ পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’’
তিনি জানাচ্ছেন, বহুতলের মেঝেতে কোথাও জল জমে রয়েছে বা খোলা জায়গায় অব্যবহৃত পাত্রে কোথাও পরিষ্কার জল জমে থাকলেও সেখানে ডিম পাড়ছে এডিস মশা। এই এলাকার বহুতলে মেঝেয় জমা জলে লার্ভা দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি জানান, একটি এডিস মশা ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে অন্তত নয় থেকে দশ দিন সময় লাগে। তাই তাঁরা সপ্তাহে দু’বার করে জমা জল ফেলে দিতে বলছেন। সতীনাথবাবু বলেন, ‘‘নির্মীয়মাণ বহুতলের বেশ কয়েকটি জায়গায় মেঝেতে দেখলাম জল জমে রয়েছে এবং সেখানে এডিসের লার্ভাও রয়েছে। এই জায়গাগুলি থেকে যে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে সে কথা আমরা পুরসভাকে জানিয়েছি।
এ দিনও ওই এলাকায় বাড়ি বাড়ি জ্বরের সমীক্ষা হয়েছে। বেশ কয়েকজন জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সন্ধানও মিলেছে। তাঁদের প্রত্যেকের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।
জেলাশাসক অলকেশপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘যে এলাকায় একাধিক ডেঙ্গি আক্রান্তের সন্ধান মিলেছে সেই এলাকায় নির্মীয়মাণ বহুতলে যদি এ ভাবে জল জমিয়ে রাখা হয়, তাহলে জরিমানা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ পুরপ্রধান সামিমদাদ খান বলেন, ‘‘আমাদের কর্মীরা এলাকায় নজরদারি চালাচ্ছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজও চলছে। জল যাতে না জমে থাকে, সে দিকে নজর রাখতে বলা হবে। তারপরেও যদি দেখা যায় কাজ হচ্ছে না, তখন কড়া হতে হবে।’’