রাজনগরের বেলেড়া তালপাতার পুথি। নিজস্ব চিত্র
তালপাতার পুথিগুলি বহু প্রাচীন। পরে তা থেকে নকল করে পরে ভুর্জি পাতায় লেখা হয়েছে। কিন্তু, ভুর্জি পাতায় লেখা পুথিটি বয়সে অপেক্ষাকৃত নবীণ হলেও, অতি জীর্ণ অবস্থায় রয়েছে সব ক’টি পুথিই।
ষষ্ঠীর সকাল। রাজনগরের বেলাড়া গ্রামের দুর্গা মন্দিরের দাওয়ায় বসে সত্তরোর্ধ্ব পুরোহিত প্রফুল্ল ঘোষাল লাল শালুর বাঁধন খুলে সযত্নে বের করে আনলেন তাল ও ভুর্জি পাতায় লেখা পুথিগুলি। প্রাচীন ওই দুর্গাপুজোর গোটা পুজোর বিধি এবং মন্ত্র সবই যে পুথিতে আটকে। ঐতিহ্যশালী সেই পুথিগুলি এক দিকে গর্বের অন্য দিকে হতাশাও বটে।
তাই ফি বছর দুর্গাপুজোর সময় পুথিগুলো বের করলেই মনটা খারাপ হয়ে যায় বৃদ্ধ পুরোহিত প্রফুল্লবাবুর। বলেন, ‘‘এ ভাবে আর কত দিন! আমার না হয় মুখস্ত হয়ে গিয়েছে। পুথির বিবর্ণ ও ছিঁড়ে যাওয়া পাতায় হাত পড়লেই সব চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমার অবর্তমানে কী ভাবে হবে পুজো?’’
শুধু পুরোহিত নন। এই বিষয়ে সমান চিন্তিত বেলেড়া দুর্গাপুজোর দায়িত্বে থাকা শরিকেরাও। বর্ষীয়ান শরিক রামচন্দ্র সিকদার, বীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীদের কথায়, ‘‘পুথিগুলি নষ্ট হয়ে গেলে কী ভাবে পুজো হবে সত্যিই ভেবে পাচ্ছি না।’’ প্রাচীন এই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে ইতিহাস। পারিবারিক ইতিহাস বলছে, ভবানীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদাইপুর গ্রামে বাংলার ১০০১ সালে এই পুজোর সূচনা হয়। তা শুরু করেছিলেন পূর্বপুরুষ গোপালচন্দ্র দেব শর্মন। পরে জঙ্গল ঘেরা বেলাড়ায় পুজো উঠে আসে ১০১০ সালে। শ্রীধর ও কৃতী দেব শর্মনদের চেষ্টায়। বর্তমানে চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই পুজোর সেবাইত সিকদারের দুটি পরিবার এবং দৌহিত্র চক্রবর্তী ও বন্দ্যোপাধ্যায়দের দুটি মিলিয়ে চারটি পরিবার। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন পুজো পদ্ধতি এবং পুথির ইতিহাস।
রামচন্দ্রবাবু, বীরেনবাবু ও আর এক সেবাইত শ্রদ্ধানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়রা বলছেন, ‘‘তালপতার মোট তিনটি পুথি রয়েছে। দুটি দুর্গাপুজোর। বাকিটা জন্মাষ্টমীর পুজো বিধি নিয়ে। মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষায় সংস্কৃত উচ্চারণে লেখা।’’ পুথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুয়ায়ী, ১০১০ সালে দুর্গাপুজো সংক্রান্ত দুটি পুথি লিখেছিলেন বলরাম বাচস্পতি নামে তৎকালীন এক সংস্কৃত পণ্ডিত। তালপাতার পুথিগুলি প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠলে বাংলা ১৩১৬ সালে তালপতার পুথিটি নকল করে লেখা হয় ভুর্জি পাতায়। এত কাল ভুর্জি
পাতায় লেখা পুথিটি ব্যবহৃত হলেও, সেটাও অদূর ভবিষ্যতে সম্ভব নয়। তালপাতায় লেখা পুথিগুলি পড়ার মতো থাকলেও সামান্য নাড়াচাড়া করলেই ভেঙে যাচ্ছে। উপায় একটাই পুথিগুলির সংরক্ষণ। কিন্তু কোন পথে গেলে সেটা সম্ভব, জানেন না রামচন্দ্রবাবুরা।
তবে ষষ্ঠীর সকালের পরে সেই চিন্তা আপাতত সরিয়ে পুজোর জোগাড়ের দিকে মনোনিবেশ করতে চান সেবাইতরা। কারণ, রাজনগরের প্রান্তিক ওই গ্রামটি বিশেষ ভাবে পরিচিত প্রসিদ্ধ দুর্গাপুজোর জন্যই। আদতে পারিবারিক হলেও পুজোর সঙ্গে জুড়ে গোটা গ্রাম। ব্লক, ব্লকের বাইরেও ছড়িয়ে রয়েছে বিখ্যাত বেলেড়া মায়ের কথা। পুজোর খরচ থেকে ভোগ, আলো থেকে সিসি ক্যামেরা, সমস্ত আয়োজনই হয় ভক্তদের দানে। শরিকরা বলছেন, ‘‘পরিশ্রম ছাড়া পুজোর সময় আর কিছু নিয়ে ভাবতে হয় না।’’ পরিবারের মেয়ে রেণুকা চক্রবর্তী, বধূ রিনা সিকদার, প্রতিমা সিকদার, মালতি চক্রবর্তীরা বলছেন, ‘‘উপোস থেকে আয়োজন করতে করতে ক্লান্ত লাগে। তবুও মা-র টানে সব কষ্ট লাঘব হয়ে যায়।’’