সিউড়ির এক স্কুলের পাঁচিলের সেই পোস্টার। নিজস্ব চিত্র
সরকারি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বারবার। বীরভূমেও বিক্ষোভ ও মিছিল হয়েছে। এ বার সিউড়ির বেশ কিছু স্কুলে পোস্টার লাগানো হল গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে। পোস্টারে লেখা হয়েছে, ‘স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ এবং কলেজের অধ্যাপক-অধ্যাপিকাগণের প্রাইভেট টিউশন আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। তা হলে এই মানুষ গড়ার কারিগরগণ কী ভাবে আইনকে উপেক্ষা করে বিপুল অর্থের বিনিময়ে প্রাইভেট টিউশন করে চলেছেন? সরকারি আইনকে মান্যতা দিয়ে কলেজের অধ্যাপক-অধ্যাপিকা ও স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করুন।’
নিয়ম অনুসারে কোনও সরকারি বা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা বা কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রাইভেট টিউশন করা নিয়মবিরুদ্ধ। কিন্তু গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির অভিযোগ, নিয়ম উপেক্ষা করে গোটা জেলাতেই স্কুল শিক্ষকদের একাংশ টাকার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রী পড়াচ্ছেন। সিউড়ি শহরেও ছবিটা আলাদা নয়। শহরের বেশ কিছু সরকারি স্কুলের শিক্ষক নিয়ম লঙ্ঘন করে গৃহশিক্ষকতা করছেন। গৃহশিক্ষকদের আরও দাবি, ক্লাসের পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেতে অনেক পড়ুয়াই স্কুল শিক্ষকের কাছে আলাদা ভাবে পড়ে। এর ফলে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে গৃহশিক্ষকদের। এর বিরুদ্ধে গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির সদস্যেরা কখনও জেলা স্কুল পরিদর্শককে স্মারকলিপি দিয়েছেন, কখনও ব্যানার হাতে রাস্তায় নেমেছেন। এ বার তাঁরা সিউড়ির বেশ কিছু স্কুলে পোস্টার লাগালেন। সমিতির জেলা আহ্বায়ক অভিজিৎ চট্টরাজ বলেন, ‘‘সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষকেরা প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করুন, এটাই আমাদের মূল দাবি। এই দাবি পূরণের জন্য আমরা বেশ কিছু কর্মসূচিও নিয়েছি। সিউড়ি শহরে এই পোস্টার লাগানো আমাদের সেই কর্মসূচিরই অঙ্গ।’’
কিন্তু এ ভাবে কি স্কুলে পোস্টার দেওয়া যায়, সে প্রশ্নও উঠেছে। অভিজিৎবাবুর ব্যাখ্যা, ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যেই পোস্টার দিয়েছে। তিনি জানান, বীরভূমে তাঁদের সংগঠনের দুশোর বেশি গৃহশিক্ষক আছেন। সিউড়ি শহরে সেই সংখ্যা পঞ্চাশের কিছু বেশি। তাঁর দাবি, ‘‘সরকারি এবং সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষকদের একাংশের প্রাইভেট টিউশনির জন্য আমাদের রুজি-রোজগার সঙ্কটে পড়েছে। অবিলম্বে এটা বন্ধ না করা হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনের পথে হাঁটতে বাধ্য হব।’’ গৃহশিক্ষকদের দাবিকে কার্যত সমর্থন করে তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনের জেলা সভাপতি প্রলয় নায়েক বলেন, ‘‘আমরা সরকারি নিয়মকে অমান্য করে স্কুল শিক্ষকদের টিউশনি মোটেও সমর্থন করি না। এ নিয়ে আমরা শিক্ষকদের বেশ কয়েক বার সতর্কও করেছি। কারণ, যেটুকু সময় ক্লাসের জন্য বরাদ্দ, সেটাই যথেষ্ট। কেউ যদি নিখরচায় ছাত্রছাত্রীদের পড়া দেখান, তা হলে কোনও অসুবিধা নেই। তবে অর্থের বিনিময়ে আলাদা করে পড়ানো সমর্থন করা যায় না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘আমরা জেনেছি, কিছু শিক্ষক ছাত্রছাত্রীদের বলছেন, তাঁর কাছে না পড়লে প্র্যাক্টিক্যালে নম্বর কম পাবে। এ রকম রিপোর্ট আমাদের কাছে এসেছে। ওই শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি ভাবে এবং সংগঠনের পক্ষ থেকে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হবে।’’
জেলা স্কুল পরিদর্শক (মাধ্যমিক) সুজিত সরকার বলেন, ‘‘এর আগেও আমরা এই অভিযোগ পেয়েছি। এর প্রেক্ষিতে তিনটি মহকুমার সমস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠক করে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাঁদের স্কুলের কেউ টিফসন করান কিনা, তা জানাতে। তাঁদের স্কুলের কোনও শিক্ষক বা শিক্ষিকা প্রাইভেটে পড়াচ্ছেন কিনা জানতে, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে লিখিত বিবৃতি নেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে প্রধান শিক্ষকদের।’’ তিনি জানান, কোনও শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রাইভেট টিউশন করলে স্কুল পরিচালন সমিতির পাশাপাশি শিক্ষা দফতরও ব্যবস্থা নেবে। কারণ এটা পুরোপুরি আইন-বিরুদ্ধ।
যদিও সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা টিউশন বন্ধ করে দিলে ছাত্রছাত্রীদেরই ক্ষতি হবে বলে মনে করেন অভিভাবকদের একাংশ। তাঁদের মতে, ‘‘অধিকাংশ গৃহশিক্ষকেরই পড়ানোর মান সরকারি স্কুল শিক্ষকদের মতো নয়। তাই আমাদের সন্তানদের পড়াশোনার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।’’