হিংসা, হানাহানি থেমেছে। এটাই এখন রানিবাঁধ বাজারের প্রতিদিনের ছবি। ছবি: উমাকান্ত ধর
দেওয়ালে বুলেটের চিহ্ন আজও দেখা যাচ্ছে। তবে, বন্দুকবাজদের ভয় আর মানুষের মনে নেই। এক সময়কার বন দফতরের অতিথিশালা বোমা বিস্ফোরণে ধ্বংসস্তূপের রূপ ধরে সে ভাবেই পড়ে রয়েছে। তবে, সেই দিন এখন নিছকই স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়। হিংসা, হানাহানি, চাপ ধরা সেই আতঙ্কের দিনগুলি পার হয়েছে। বাজার বসছে, স্কুল খুলছে, অফিস-কাছারিও স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। সন্ধ্যা নামলেই রাস্তা আর আগের মতো সুনসান হয়ে যায় না। রক্তঝরা সেই অধ্যায় পেরিয়ে ক্রমশ স্বাভাবিক জীবনের ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত জঙ্গলমহলের এই জনপদে।
রানিবাঁধে আপনাকে স্বাগত!
শেষ মে-র প্রবল গরমে জনশূন্য বারোমাইল জঙ্গলের রাস্তা ধরে ভরদুপুরে সাইকেলের ক্যারিয়ারে স্ত্রীকে চাপিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন পেশায় নির্মাণকর্মী অনিল মাহাতো। বছর পাঁচেক আগের স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে গড়গড় করে অনিলবাবু বলছিলেন, “সকাল হোক আর সন্ধ্যে, জঙ্গলের ধারপাশ মাড়ানোরও সাহস হত না আমাদের! মাওবাদী তো বটেই, বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে পুলিশের জেরার ভয়ও তাড়া করত। এখন অন্ধকারেও অনেকে নিশ্চিন্তে যাতায়াত করি।’’
কেমন ছিল মাওবাদী হিংসার সেই সব দিন?
রানিবাঁধ পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি, তৃণমূলের বলরাম মাহাতোর অফিসে বসে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন এই পঞ্চায়েত সমিতিরই সদস্যা, রানিবাঁধের মৌলা গ্রামের বাসিন্দা শ্যামলী মাহাতো। তাঁর কথায়, ‘‘রানিবাঁধ ব্লকের মিঠাআম, জামগেড়্যা, বাজডাঙা, মৌলা-র মতো একাধিক গ্রামের মানুষ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতেন সন্ধ্যে হলেই। হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গ্রামবাসীদের ঘরে ঘরে ভাত চাইতে আসত মুখে গামছা, রুমাল বাঁধা লোকগুলো। অনেক মহিলাও থাকত ওই দলে। জোর করে তাদের বৈঠকে নিয়ে যেত গ্রামবাসীদের।’’ সেই সব দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে শ্যামলীদেবীর। “গ্রামের ‘মরদ’-দের ওদের দলে জোর করে যোগ দেওয়াত। কেউ যেতে না চাইলে টেনে নিয়ে যেত ওরা। ধমক দিত প্রাণে মেরে ফেলার।”—এক টানা বলে চললেন এই মহিলা। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, “ওরা আসবে বলে সন্ধ্যে থেকে আমরা বাড়ির ছাদে লুকিয়ে থাকতাম। কপাট না খুললে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে তল্লাশি চালাতো ওরা। হাতের সামনে যাকেই পেত তাকেই নিয়ে যেত বৈঠকে যোগ দিতে।’’
বারোমাইলের জঙ্গলে পর্যটনস্থল গড়ে তুলতে এক সময় সুতানে অতিথিশালা গড়ে তুলেছিল বাম সরকার। সেখানে গাছপালা নিয়ে গবেষণা করতেও আসতেন অনেকে। পরবর্তী কালে জঙ্গলে মাওবাদীদের দাপাদাপির জেরে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে ওঠে। জঙ্গলের অতিথিশালাও রক্ষী-শিবিরে পরিণত হয়। এক সময় শিবির উঠে যাওয়ার পরে তার দখল নেয় মাওবাদীরা। বোমা বিস্ফোরণে সাজানো গোছানো কটেজগুলিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল মাওবাদীরা। আজও সেই ভাঙাচোরা কটেজগুলি সেই সময়কার নাশকতার স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। নির্জন ঘন জঙ্গল পথ দিয়ে সুতান যাওয়ার পথে চোখে পড়ে ব্লক প্রশাসনের বিজ্ঞাপনে ‘জঙ্গলের নির্জনতা অনুভব’ করার আহ্বান। তবে আরও গভীরে বেশ কিছু গাছের ডালে ছেঁড়া লুঙ্গি, কাপড়ের টুকরো ঝুলতে দেখে অনেকেই কোনও ‘সঙ্কেত’ বলে ভেবে বসতে পারেন। তবে, মাঝ জঙ্গলের পাকা রাস্তার উপর ভেড়ার পাল নিয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকা কালু মান্ডি আশ্বাসের সুরে বলেন, “জঙ্গল এখন শান্ত।’’
শান্তির কথা শোনাচ্ছেন রানিবাঁধ ব্লক সদরের মানুষজনও। সদর বাজারের মুদি দোকানি রামরঞ্জন মণ্ডল বলছিলেন, “সেই সময় ব্যবসাপাট ডকে উঠেছিল। মাসের বেশির ভাগ দিন দোকানই খোলা যেত না। কোনও কোনও দিন এক বেলা দোকান খুলে বন্ধ করে দিতে হয়েছে।’’ আর এখন? জবাব এল, “খোলা মনে আমরা বাঁচতে পারছি। অনেক রাত পর্যন্ত দোকান করছি। ক্রেতারাও ভিড় জমাচ্ছেন বাজারে।’’ এই বাজারেরই একটি জুতোর দোকানের কর্মী, হেতাপাথর গ্রামের তাপস রুইদাস ও তামাখুনের দুর্গাচরণ মাহাতো। তাঁদের কথায়, “আগে সন্ধ্যে নামার আগেই বাড়ি চলে যেতে হত। এখন রাত সাড়ে ন’টা পর্যন্ত দোকানে থাকি।’’ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যা শ্যামলীদেবী বলেন, “মানুষ এখন অনেক নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়ান।’’
এক সময় খাদ্য, কর্ম, বাসস্থানের দাবিতেই মাওবাদীদের সঙ্গে ভিড়ে ‘বিপথে’ গিয়েছিলেন এলাকার বেশ কিছু যুবক-যুবতী। আজও সেই দাবি মেটেনি অনেকের। তবে, এই ব্লকে সম্ভাবনা আছে প্রচুর। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৫৮ শতাংশই তফসিলি জাতি-উপজাতি সম্প্রদায়ের। তাঁদের নিজস্ব শিল্পকলা রয়েছে। শাল, পিয়াল, মহুল গাছের ঘন জঙ্গল, ছোট বড় টিলায় ঘেরা এই ব্লকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঠিকরে পড়ছে। দরকার শুধু তাকে সঠিক পদ্ধতিতে তুলে ধরার। বন দফতরের রানিবাঁধ রেঞ্জের আধিকারিক বাদলচন্দ্র মাহাতো বলেন, “এখানকার গভীর ঘন জঙ্গলের টানে ছুটে আসেন বহু মানুষ। শীতকালে চড়ুইভাতিরও ভিড় জমছে বিগত কয়েক বছর। পর্যটন বিভাগের সঙ্গে বন দফতরও চিন্তা ভাবনা করছে কিভাবে এই এলাকাকে আরও আকর্ষনীয় করে তোলা যায়।’’
জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর দাবি, আদিবাসী লোকশিল্পীদের শিল্পী ভাতা চালু করার ফলে নিয়মিত একটা রোজগারের সুযোগ পেয়েছেন এই এলাকার বহু মানুষ। এ ছাড়াও এলাকায় স্বনির্ভর দল গড়ে নানা হাতের কাজ শেখানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে ব্লকে। এলাকার রাস্তা, সেতু গড়ে তোলার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। তিনি বলেন, “শিক্ষাক্ষেত্রেও রানিবাঁধ ব্লক এগোচ্ছে। তাই এখানে কলেজ গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কলেজটি উদ্বোধনও হয়ে যাবে। আরও বেশ কিছু স্কুল ও হস্টেল গড়ে তোলা হচ্ছে। স্টেডিয়ামও গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছি।’’
শান্তি ফিরেছে। শাসকদল দাবি করছে, উন্নয়নও হচ্ছে। অথচ এখনও প্রায়ই জলকষ্টের সমস্যা, স্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেহাল দশার প্রতিবাদে প্রায়ই পথে নামতে দেখা যায় এই ব্লকের মানুষদের। রাস্তা না হওয়ায় বহু জায়গা এখনও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন বলেও অভিযোগ জানাচ্ছেন এখানকার মানুষজন। পর্যটনের প্রচুর সুযোগ থাকলেও সেভাবে কোনও পদক্ষেপই চোখে পড়ছে না। তাই এখানের মানুষ পুবে খাটতে যাওয়া অথবা বৃষ্টি নির্ভর চাষের উপরেই এখনও নির্ভরশীল। এই সমস্যা কবে মেটে, তারই অপেক্ষায় রানিবাঁধ।