স্বস্তি: নতুন কার্ড নিয়ে সঞ্জীব মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো
ভোটার পরিচয়পত্রে তাঁর বয়স তেইশ ছাড়িয়েছে। কিন্তু মুখ-চোখের গড়ন ও শারীরিক গঠন একেবারে ছোট্ট শিশুর মতোই। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের জন্যই বার বার চেষ্টা করেও আধার কার্ডের আবেদন বাতিল হয়ে যাচ্ছিল পুরুলিয়া ১ ব্লকের গাড়াফুসড় গ্রামের বাসিন্দা অস্টিওপোরোসিস আক্রান্ত সঞ্জীব মাহাতোর। এ দিকে আধার কার্ড থাকলে প্রতিবন্ধী ভাতা বন্ধ হয়ে যাবে। শেষে ওই যুবকের পরিবার আধার কার্ড তৈরির দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (ইউআইডিএআই) কাছে চিঠি লিখে ভোগান্তির কথা জানান। চিঠি পেয়ে দুর্গাপুজোর মুখে সংস্থার রাঁচীর অফিস থেকে আধিকারিকেরা পুরুলিয়ায় এসে ওই যুবকের ছবি ও অন্যান্য নথি সংগ্রহ করে নিয়ে যান। মঙ্গলবার তাঁরাই মঙ্গলবার পুরুলিয়ায় এসে সঞ্জীবের হাতে আধার কার্ড তুলে দিলেন।
এ নিয়ে সঞ্জীবের ভোগান্তির সূত্রপাত ২০১৫ থেকে। এলাকায় আধার কার্ড করানোর শিবিরে সঞ্জীবকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা বৃন্দাবনবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘গ্রামের শিবির থেকে পুরুলিয়া শহরের শিবিরে নিয়ে গিয়েছি। কিন্তু বার বার জানানো হয়েছে, ছেলের ছবির সঙ্গে বয়স মিলছে না। কিন্তু এই রোগে শরীরের ভিতরের একের পর এক হাড় ভাঙতে ভাঙতে যুবকও যে শিশুর মতো দেখতে হয়ে যায়, ওঁদের বোঝানো যাচ্ছিল না।’’
তিনি জানান, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সঞ্জীব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু প্রথমে তার পা ভাঙে। সুস্থ হতে না হতেই হাত ভাঙে। তারপর কাঁধ। এমনি করে দশ-বারো বার শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় ভেঙেছে। ডাক্তার জানিয়েছিল, ক্রমশ ওর দেহ ছোট হয়ে যাবে। তাই হল। এখন সঞ্জীবের ওজন ১৫ কেজি, উচ্চতা ফুট দুয়েকের সামান্য বেশি। কোলে করে তাকে নিয়ে যেতে হয়। বৃন্দাবনবাবু বলেন, ‘‘সঞ্জীব প্রতিবন্ধী ভাতা পায়। কিন্তু এই ভাতা চালু থাকার জন্য আধার আবশ্যিক। এ কথা জানতে পেরেই ছেলের আধার কার্ড করানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি।’’
ওই গ্রামের বাসিন্দা কমন সার্ভিস সেন্টার নামে কেন্দ্রীয় পরিষেবা প্রদানকারী একটি সংস্থার প্রতিনিধি মৃণালকান্তি মাহাতো বলেন, ‘‘আমিও কয়েকবার সঞ্জীবের আধারের আবেদন পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ওর বয়সের সঙ্গে ছবির মিল না থাকায়, আধার কার্ডের কর্তৃপক্ষ ওকে কার্ড দিতে চাননি।’’ ওই সেন্টারের পুরুলিয়া কেন্দ্রের প্রতিনিধি দেবাশিস চক্রবর্তী জানান, ওই যুবকের শারীরিক সমস্যার কথা জানিয়ে এবং চার বার ওঁর আবেদন বাতিল হয়েছে জানিয়ে, ইউআইডিএআই-এর রাঁচীর আঞ্চলিক অফিসে চিঠি লেখা হয়। তাতেই কাজ হয়।
ইউআইডিএআই-এর উপ-অধিকর্তা রাজেশকুমার প্রসাদ বলেন, ‘‘এই যুবকের পরিবার সঞ্জীবের সমস্যা জানিয়ে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা আমার মন ছুঁয়ে যায়। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, ওই যুবকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর হাতে আধার কার্ড তুলে দেবই।’’
দেবাশিসবাবু জানান, চিঠি পাওয়ার পরে আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে যোগাযোগ করে পুরো বিষয়টি জানতে চাওয়া হয়। সঞ্জীবের রোগের সমস্যার কথা জানিয়ে, তথ্যের সমর্থনে ভিডিও পাঠানো হয়। এরপরে ঠিক পুজোর মুখে রাজেশকুমার পুরুলিয়ায় আসেন। সেই সময়ে সঞ্জীবের ফের পা ভেঙেছিল। সেই অবস্থায় তাকে পুরুলিয়ায় নিয়ে আসেন বৃন্দাবনবাবু। জানা গিয়েছে, সেখান থেকেই রাজেশবাবু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে সঞ্জীবের আবেদন আধার কার্ডের সার্ভারে আপলোড করেন।
মঙ্গলবার শিশু দিবসে পুরুলিয়ায় ‘গো এহেড সঞ্জীব উইথ ইয়োর আধার’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় সংস্থার অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল সুনীল প্রসাদ বলেন, ‘‘আধারের ইতিহাসে এই ঘটনা বোধহয় বিরল। এ রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সঞ্জীবের পরিবারের লড়াই ও আমাদের প্রচেষ্টা— দু’টি বিষয়ই বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য।
এ দিনের অনুষ্ঠানে পুরুলিয়ার পুরপ্রধান সামিমদাদ খান সঞ্জীবের পরিবারের লড়াইকে কুর্নিস জানিয়ে তাঁর চেয়ার সঞ্জীবের জন্য ছেড়ে দেন। পুরপ্রধান বলেন, ‘‘সঞ্জীব ও তাঁর পরিবারের হার না মানা মনোভাবকে সম্মান জানিয়ে আমার চেয়ার এ দিনের অনুষ্ঠানে সঞ্জীবকে ছেড়ে দিচ্ছি।’’
টানা প্রায় তিন বছরের লড়াইয়ের পরে এ দিন ছেলের আধার কার্ড হাতে পেয়ে খুশি বৃন্দাবনবাবু। স্বগতোক্তি করেন, ‘‘যাক ছেলের ভাতাটা বোধহয় আর বন্ধ হবে না। আর সঞ্জীবের প্রতিক্রিয়া, ‘‘সবাই মিলে এগিয়ে আসায় সত্যি সত্যি আমার আধার কার্ড পেলাম।’’