নন্দুয়াড়ায় ১০ নম্বর ওয়ার্ডে পাহাড়ের তলায় প্রাথমিক স্কুলের বুথে তিনটের পরেও ভোটারদের লাইন। —নিজস্ব চিত্র।
নির্বাচন ঘিরে অশান্তির কোন পূর্বাভাস ছিল না। প্রত্যাশা মতোই অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হল রঘুনাথপুরে। কার্যত উৎসবের মেজাজে ভোট দিলেন ভোটররা। শহরের ২১টি বুথে ভোটের গড় ৮২.৫৭ শতাংশ। আর এই বিশাল হারে ভোট পড়ার প্রেক্ষাপটেই এ বার অন্য কিছু ঘটার আশায় বুক বাঁধছে বিরোধীরা। বস্তুত, রাজনীতি বা নির্বাচনের সহজ পাটিগণিত অনুযায়ী ভোটের হার বেশি হলে স্বভাবত সেটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট হয়েছে বলেই মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। সেই প্রেক্ষিতেই বিজেপি, বাম এমনকী এসইউসি, নির্দলদের দাবি, রঘুনাথপুরে এ বার বদল ঘটবে। অন্য দিকে, বিরোধীদের দাবিকে উড়িয়ে দিয়ে শাসক শিবিরের ব্যাখ্যা, তারা ছক কষে সংগঠনকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করে ভোটটা করিয়েছেন বলেই ভোটের হার বেশি হয়েছে। যার অ্যাডভান্টেজ পাবে তারাই।
শনিবার কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া রঘুনাথপুরে ভোট নিয়ে কোনও সমস্যাই পড়তে হয়নি পুলিশ-প্রশাসনকে। এমনকী শাসকদলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগও তোলেনি বিরোধীরা। বুথে, বুথে ঘুরে দেখা গিয়েছে যথেষ্ট মাত্রাতেই সক্রিয় ছিল পুলিশ-প্রশাসন। এমনকী পুলিশের অতিসক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে। সকালের দিকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মহকুমা গ্রন্থাগারের বুথে পিন্টু বাউরি নামে এক ভোটারকে চড় মারার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। ওই ঘটনার জেরে দোষী পুলিশ কর্মীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়ার দাবিতে বিক্ষোভে সরব হয়েছিলেন ভোটররা। ১৫-২০ মিনিট ভোট বন্ধ ছিল ওই বুথে। খবর পাওয়া মাত্রই বুথে পৌঁছেছিলেন পুলিশ-প্রশাসনের পদস্থ কর্তারা। স্থানীয়ভাবে জানা গিয়েছে, গ্রন্থাগারে ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দু’টি বুথ রয়েছে। পিন্টু কোন বুথে ভোট দেবেন বুঝতে না পেরে ঘোরাঘুরি করছিলেন। অভিযোগ, সেই সময়েই তাঁকে মারধর করে বুথ থেকে বের করে দিয়েছিলেন এক পুলিশকর্মী। এই ঘটনা ছাড়া ৪, ১, ৮—এই তিনটি ওয়ার্ডের তিনটি বুথে ইভিএম বিকল হয়ে পড়ায় ভোটগ্রহণ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ ছিল। তবে এই ঘটনাগুলি ছাড়া ভোট মিটেছে নির্বিঘ্নেই।
ভোটের আগের দু’দিন পরপর বৃষ্টি হওয়ায় শনিবার পুরোদিনই আবহাওয়া ছিল যথেষ্ট মনোরম। সকাল থেকেই বুথগুলিতে ভোটারদের লম্বা লাইন পড়েছিল। বিকেলের দিকেও ২১টির মধ্যে দশ-বারোটি বুথে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়েছে। তিনটের সময়ে ভোট শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ভোট মিটতে পাঁচটা পার হয়ে যায়। পুরসভার ১৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে অন্তত আটটি ওয়ার্ডে ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি বা তার বেশি ভোট পড়েছে। ১২ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথে ভোট পড়েছে ৯০ শতাংশের বেশি। ঘটনা হল, ভোটের হার ভাল হবে আশা থাকলেও এই হারে ভোট পড়বে বলে ভাবেননি প্রশাসনের পদস্থ কর্তারাও। পুলিশের এক আধিকারিকের কথায়, ‘‘নির্বাচনের আগের দিন থেকে নির্বিঘ্নে ভোট হবে, এই বার্তাটা আমরা ভোটারদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই হারে ভোট পড়বে ভাবা যায়নি।”
এই পরিস্থিতিতে ভোট মিটতেই কার ঝুলিতে কত ভোট পড়ল তার অঙ্ক মেলাতে বসে পড়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু এই বিশাল সংখ্যক হারে ভোট পড়ার ফলে সেই অঙ্ক মেলানোর কাজটা বেশ কঠিনই ঠেকছে দলগুলির প্রার্থীদের কাছে। রঘুনাথপুরে বরাবরাই ভোটের হার বেশি থাকলেও অতীতের নির্বাচনগুলিতে এই হারে ভোট হয়নি। প্রশাসন সূত্রেই জানা যাচ্ছে, আগের পুরনির্বাচনে ভোট পড়েছিল প্রায় ৭৩ শতাংশ। এক বছর আগে লোকসভাতেও রঘুনাথপুর শহরে ভোটের হার ছিল কমবেশি প্রায় একই। অতীতের নির্বাচনগুলি থেকে এ বার ১১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পড়ায় সেই ভোট কার পক্ষে যাচ্ছে তা নিয়েই চলছে রাজনৈতিক পর্যালোচনা। বেশি ভোট পড়ার প্রেক্ষিতে নির্বাচনে আশাতীত ফল হবে বলে দাবি করছে বিজেপি। গেরুয়া শিবিরের দাবি, লোকসভাতে বিধানসভার তুলনায় ভোট বেশি পড়েছিল। এই অতিরিক্ত ভোটের দৌলতেই রঘুনাথপুরে পাঁচটি আসনে এগিয়ে গিয়েছিল তারা। দলের শহর মণ্ডল কমিটির সম্পাদক শুভঙ্কর কর বলেন, ‘‘বেশি হারে ভোট পড়ার অর্থই সেটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ভোট। রঘুনাথপুরে এ বার সেটাই হয়েছে। মঙ্গলবার সকালেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। এ বার শহর থেকে তৃণমূলকে পাততাড়ি গোটাতে হচ্ছে।’’ ভাল হারে ভোট পড়ার ঘটনায় তারাই সুবিধা পাচ্ছে বলে দাবি বামেদের। দলের লোকাল কমিটির সম্পাদক লোকনাথ হালদারের ব্যাখ্যা, ‘‘এই সংখ্যক ভোট পড়া শাসকদলের প্রতি ভোটারদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের ইঙ্গিত। যার সুবিধা পাবে বামেরা।’’ অন্য দিকে স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক পূর্নচন্দ্র বাউরির দাবি, ‘‘ভোটের দিন দলের মেশিনারিকে পুরোদস্তুর ব্যবহার করে ভোট করানো হয়েছে। কর্মীদের প্রতি নির্দেশই ছিল, আমাদের সমর্থনে থাকা ভোটাররা যেন ভোটটা দেন। সেটা নিশ্চিত করার জন্য সেই প্রেক্ষিতেই এ বার ভোট বেশি পড়েছে। যা আদতে আমাদেরই পক্ষে যাচ্ছে।’’
ঘটনা হল, রঘুনাথপুরে এ বার পুরবোর্ড কারা গঠন করবে তা নিয়ে ফল গণনার একদিন আগেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না দলগুলি। প্রকাশ্যে তারা যাই দাবি করুক না কেন একান্ত আলোচনাতেই বাম, ডান দু’পক্ষেরই নেতারা স্বীকার করছেন, ‘‘অতীতের থেকে এ বার ১১ শতাংশ ভোট বেশি পড়ায় কোন পক্ষের সুবিধা হচ্ছে সেটা এখনও পরিষ্কার নয়।’’ পুরসভার ১৩টি ওয়ার্ডেই নির্বাচনের বিন্যাস ও সমীকরণ পৃথক হওয়াতে ভোট কাটাকুটির জটিল অঙ্কে পুরসভার দখল কার দিকে যেতে পারে সেটাও পরিষ্কার নয় বলে মত স্থানীয় রাজনৈতিক মহলের। চারটি ওয়ার্ডে ভোট কাটাকুটির ক্ষেত্রে এসইউসি ও নির্দলরা ফ্যাক্টর হিসেবে উঠে আসছে বলে জানাচ্ছে দলগুলিই।
এই অবস্থায় টানা তিনবার তৃণমূলের হ্যাটট্রিক না কি পরিবর্তনের পরিবর্তন— জানতে অধীর অপেক্ষায় রঘুনাথপুর।