বহিরাগতদের তাড়া পুলিশের। শনিবার এমনই ছবি দেখল বাঁকুড়া। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
সন্তুষ্ট বিরোধীরা। অসন্তোষ শাসক-শিবিরে। বাঁকুড়ায় দু’পক্ষেরই এই দুই বিপরীত মতের কেন্দ্রে রয়েছে জেলার পুলিশ। ঘটনা হল, গোটা রাজ্যে শনিবারের পুরভোটে পুলিশের যে ভূমিকা দেখা গিয়েছে, বাঁকুড়ার তিন পুরসভায় তার চেয়ে কিছুটা আলাদা চেহারাতেই পুলিশকে দেখেছেন সাধারণ মানুষ।কেমন সে চেহারা? অভিযোগ পাওয়ার পর পদক্ষেপ করতে সময় নষ্ট নয়, ঘটনাস্থলে গিয়ে শাসক-বিরোধী ভেদাভেদ নয়— ভোটে অশান্তি রুখতে এই পন্থাই অবলম্বন করেছিল বাঁকুড়া পুলিশ। তাই ছুটকোছাটকা কিছু ঘটনা ছাড়া ভোটও হল নির্ঝঞ্ঝাট। বিরোধী দলেরই এক নেতার কথায়, এই ভোট ‘ফেয়ার ভোট’। যদিও পুলিশের কড়া মনোভাবের জেরে হতাশ তৃণমূল রবিবার বিক্ষোভ দেখাল সোনামুখী থানায়। সেখানে শাসকদলই অভিযোগ তুলল, পুলিশ নাকি ভোটের দিন নিরেপক্ষ ছিল না! এখানেই না থেমে ওই থানার এক পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করল তৃণমূল।
কেন্দ্রীয় বাহিনী আসছে না, নিশ্চিত হওয়ার পরেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল বিরোধীদের। রাজ্য পুলিশের নজরদারিতে থাকলে ভোটে বুথজ্যাম, ছাপ্পা, রিগিং যে হবেই, তা নিয়ে একমত ছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র কিংবা বিজেপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি সুভাষ সরকার। সিপিএমের বেশি চিন্তা ছিল সোনামুখী নিয়ে। কারণ, এই পুরসভায় তারাই ক্ষমতায় ছিল। এ বার তৃণমূল পুরসভার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সংশয় থাকায় সোনামুখীতে তাই প্রথম থেকেই দলীয় ভাবে প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল বামেরা। সাধারণ মানুষকেও প্রতিবাদে সামিল হতে বলা হয়েছিল লিফলেট ছড়িয়ে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। বাম কর্মীদের পাশাপাশি মানুষ পথে নেমে সোনামুখীতে একের পর এক বহিরাগতদের তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।
শেষ পর্যন্ত কিন্তু পুলিশের ভূমিকায় সন্তুষ্ট বিরোধীরা। ভোটের কয়েক দিন আগেই জেলা পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত ভাবে শান্তিপূর্ণ ভোট করতে পুলিশকে সক্রিয় হওয়ার দাবি তুলেছিল সিপিএম। ভোট শেষে সিপিএম নেতা অমিয়বাবু বলেছেন, “তৃণমূল জামানায় যে-সব ভোট হয়েছে, প্রতিটিতেই মানুষকে শাসানি দিয়ে, বুথ জ্যাম করে গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পুরভোটে এই ঘটনা যাতে না ঘটে, তার জন্য জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে একাধিকবার দাবি তুলেছিলাম আমরা। শেষ পর্যন্ত তারা সচেষ্ট হয়েছে। মানুষ নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছে।’’ বিজেপি নেতা সুভাষবাবুর কথায়, “পুলিশকে ফোন করে কোনও অভিযোগ জানানোর পর দ্রুত ব্যবস্থা নিতে দেখেছি। ভোটের আগের রাতে শাসক দলের কিছু নেতা-নেত্রী বাঁকুড়ার দু’টি ওয়ার্ডে টাকা দিয়ে ভোটারদের প্রভাবিত করতে চাইছিল। পুলিশকে জানানোর পরে দু’টি জায়গাতেই গিয়ে অভিযুক্তদের এলাকা থেকে বের করে দিয়েছে। ভোটের দিনেও ফোন করে পুলিশকে পেয়েছি।’’
বিষ্ণুপুরের খেমকা হাইস্কুলের বুথে (১৯ নম্বর ওয়ার্ড) পাহারায় বাহিনী। ছবিটি তুলেছেন উমাকান্ত ধর।
জেলার তিনটি পুরসভার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্ত্রাস হবার আশঙ্কা ছিল সোনামুখীতে। হয়েছেও তাই। ভোটের দিন চার জন বহিরাগতকে আটক করেছে পুলিশ। ৪৫টি তাজা বোমা মিলেছে তাদের কাছ থেকে। সোনামুখীতে যে পুলিশের বাড়তি নজর থাকবে, জেলার পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার তা আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। ভোটের দিন খাতড়ার এসডিপিও কল্যান সিংহ রায়, সারেঙ্গার আইসি রজত পাল দিনভর সোনামুখীতেই ছিলেন। সোনামুখীর সিআই দেবাশিস রাউত এবং ওসি পথিকৃৎ চট্টোপাধ্যায়রা একজোট হয়ে বিভিন্ন ওয়ার্ড সামলেছেন। ভোটের দিন বিকেল থেকে এই পুরসভায় ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সবরি রাজকুমার কে। এই পুরসভার কোনও বুথেই ছাপ্পা বা রিগিং-এর অভিযোগ ওঠেনি। এলাকায় বহিরাগতদের দেখতে পেয়ে স্থানীয় মানুষ যখনই থানায় খবর দিয়েছেন, কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ ঘটনাস্থলে গেছে। বুথ চত্বরে অযথা কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখলেও বাধা দিয়েছে পুলিশ। সোনামুখীর প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের অলিগলিতে দিনভর দাপিয়ে বেড়িয়েছে পুলিশের বাইক বাহিনী।
এতটা যে সক্রিয় হবে পুলিশ, তা আঁচ করতে পারেনি শাসক দল। সম্ভবত সেই কারণেই রবিবার দুপুরে প্রায় দু’ঘণ্টা সোনামুখী থানায় বিক্ষোভ দেখান লোকসভা ভোটে ছাপ্পাভোট করায় অভিযুক্ত বিধায়ক তথা সোনামুখী পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী দীপালি সাহা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জনা ৬০ অনুগামী। দীপালিদেবীর অভিযোগ, “ভোটের দিনে পুলিশ নিরপেক্ষ ছিল না। এক শ্রেণির পুলিশ বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কাজ করেছে। একাধিক বুথে আমাদের এজেন্টদের ঢুকতে দেয়নি। তৃণমূল কর্মীদের মারধর করেছে।’’ এমনই হতাশা ঝরে পড়ছে শাসক দলের ওই দাপুটে বিধায়কের গলায়।
অন্য দিকে, বাঁকুড়ায় ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি বুথ ছাড়া আর কোথাও বুথে ঢুকতে পারেনি দুষ্কৃতীরা। এই পুরসভায় শান্তিপূর্ণ ভোট করতে দিনভর বাহিনী নিয়ে বুথে বুথে ঘুরে বেড়িয়েছেন জেলা পুলিশের ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) বাপ্পাদিত্য ঘোষ, আইসি বিশ্বজিৎ সাহারা। জেলা পুলিশ লাইনে বসে দিনভর তিনটি পুরসভারই পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব পালন করেছেন ডিএসপি (প্রশাসন) আনন্দ সরকার। কোথাও কোনও অভিযোগ পাওয়া মাত্র বাহিনীকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়াই কাজ ছিল তাঁর। বিষ্ণুপুর পুরসভাতেও বুথে বুথে ঘুরে ভোট প্রক্রিয়া দেখেছেন এসডিপিও (বিষ্ণুপুর) জে মার্সি এবং আইসি স্বপন দত্ত।
জেলা পুলিশ সুপার নিজের বাহিনীর ভূমিকায় সন্তুষ্ট। তাঁর কথায়, “ভোট প্রক্রিয়া সুষ্ঠ ভাবে করাটাই লক্ষ্য ছিল আমাদের। কোথাও বড় কিছু ঘটনা ঘটেনি। যে কোনও অভিযোগ পাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে পদক্ষেপ করেছি আমরা। নির্বাচন কমিশনের নিয়ম নীতি কোথাও ভাঙতে দিইনি।’’ জেলাশাসক বিজয় ভারতীও বলেন, “ভোট শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে জেলায়। সমস্ত স্তরের কর্মীরাই সমান তালে কাজ করে গিয়েছেন।’’