কান্না শব্দ শুনেই সন্দেহ পড়শিদের, বাঁকুড়ায় ধৃত ছেলে

মাকে খুন করে বাড়ির পেছনে পুঁতে দিল ছেলে!

ঝুপড়ি বাড়ির ভিতরে একটি খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন পঙ্গু বৃদ্ধা। রোজই সেই কান্নার আওয়াজ কানে যেত পড়শিদের। মঙ্গলবার সকাল থেকে সেই আওয়াজ আর শোনা যায়নি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৬ ০২:০৮
Share:

এখানেই পুঁতেছি। পুলিশকে দেখাচ্ছে বিশ্বনাথ। — নিজস্ব চিত্র

ঝুপড়ি বাড়ির ভিতরে একটি খাটিয়ায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতেন পঙ্গু বৃদ্ধা। রোজই সেই কান্নার আওয়াজ কানে যেত পড়শিদের। মঙ্গলবার সকাল থেকে সেই আওয়াজ আর শোনা যায়নি। সন্দেহ হওয়ায় পুলিশকে ফোন করে পড়শিরা জানান, এই ঘটনায় বৃদ্ধার একমাত্র ছেলের হাত থাকতে পারে। পুলিশ এসে ওই বদরাগী যুবককে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে সেই যুবক জানায়, মাকে সেই খুন করেছে। বাড়ির আঙিনায় পোঁতা আছে দেহ!

Advertisement

ছেলের চিহ্নিত করে দেওয়া জায়গায় মাটি খুঁড়তেই এ দিন পাওয়া যায় মণি কুম্ভকার (৭০) নামে ওই বৃদ্ধার লাশ। নিহতের ছেলে বিশ্বনাথকে খুন করা ও দেহ লোপাটের চেষ্টার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাঁকুড়া শহরের পাঁচবাগা এলাকার এই ঘটনায় অবশ্য স্তম্ভিত নন মণিদেবীর প্রতিবেশীরা। বছরের পর বছর ধরে কী ভাবে নিজের মায়ের উপর অত্যাচার চালাত বিশ্বনাথ, তা ওই বৃদ্ধার আত্মীয় থেকে পড়শিদের মুখে মুখে ঘুরছে। যা শুনে শিউরে উঠতে পারেন অনেকেই।

তাঁদের দাবি, বছর খানেক আগেই পাড়ার মোড়ে বিশ্বনাথ তাঁর মায়ের হাতের তালু এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছিল লোহার রড দিয়ে। বিশ্বনাথের কাকিমা ভোগীবালাদেবী, খুড়তুতো ভাই দীপ কুম্ভকাররা জানাচ্ছেন, মাস খানেক আগে আবার মাকে কোলে তুলে ছুড়ে দিয়েছিল বিশ্বনাথ। পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে যায় ওই বৃদ্ধার। তাতেও রাগ কমেনি ছেলে। মায়ের দু’টি হাতও মুচড়ে ভেঙে দেয়। তার পর থেকেই শয্যাশায়ী ছিলেন মণিদেবী।

Advertisement

স্থানীয় সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাড়িতে একটি খাটিয়ায় তাঁকে ফেলে রাখত বিশ্বনাথ। সকালে পেশায় দিনমজুর বিশ্বনাথ কাজে বেরিয়ে পড়ত। দিনভর একটু জলও মুখে জুটত না বৃদ্ধার। রাতে কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পরে মায়ের মুখে এক টুকরো পাউরুটি গুঁজে দিত। সেটাই সারা দিনের খাওয়া ছিল বৃদ্ধার। দীপের স্ত্রী মমতা কুম্ভকার বলেন, “ওঁর গায়ে পিপড়ে লেগে গিয়েছিল। সারা দিন যন্ত্রণায় কাতরাতেন আর হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মেয়েদের নাম ধরে ডাকতেন।’’

এ-সব দেখেও কেন প্রতিবাদ করেননি? এলাকাবাসী ও বৃদ্ধার পরিজনদের দাবি, বিশ্বনাথের চণ্ডালে রাগ। তার পরিবারের বিষয়ে কেউ নাক গলালে কাটারি, টাঙ্গি নিয়ে বাড়িতে চড়াও হত। স্থানীয় বাসিন্দা ও আত্মীয়দের অনেকেই আগে তার রাগের শিকার হয়েছেন। কেউ তাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখলে কেটে ফেলবে বলে হুমকিও দিয়ে রেখেছিল সে। বিশ্বনাথের সৎ ভাই নিমাই কুম্ভকার বলেন, “ওর ছায়া মাড়ানোও ভয়ের ছিল। খুবই বদরাগি ছেলে। তাই আমরা কেউই সাহস পেতাম না প্রতিবাদ করার।’’ এলাকাটি জুনবেদিয়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। এলাকার পঞ্চায়েত সদস্য অদ্বৈত দে বলেন, “কিছুদিন আগে আমার কাছে এসেও হম্বিতম্বি করে বিশ্বনাথ বলে, সরকারি ভাবে তার বাড়ি করে দিতে হবে। না হলে ঝামেলা করবে।’’ স্থানীয় লোকজন জানাচ্ছেন, বিশ্বনাথের অত্যাচার সইতে না পেরে অনেক আগেই তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গিয়েছেন।

সোমবার বিকেলে পড়শিরা বিশ্বনাথকে কোদাল হাতে বাড়ির উঠোনে গর্ত খুঁড়তে দেখেন। বিশ্বনাথের কাকিমা ভোগীবালাদেবী জানালেন, বাড়ির তুলসীতলায় গেলেই মণিদেবীকে বাড়ির ভিতর খাটিয়ায় শুয়ে থাকতে দেখতেন। তাঁর কান্নার আওয়াজ শোনা যেত। সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে শেষ দেখা গিয়েছিল। মঙ্গলবার সকাল থেকে আর দেখা যায়নি। বিশ্বনাথ যে গর্ত খুঁড়েছিল, তা-ও মাটি দিয়ে বুজিয়ে ফেলা হয়েছিল। এই সব দেখেই সন্দেহ হয় তাঁদের। সকালেই বিশ্বনাথ কাজে বেরিয়ে গিয়েছিল। দুপুরে পুলিশকে সব জানান এলাকাবাসী। দুপুরে বিশ্বনাথ বাড়িতে আসতেই পুলিশ এসে তাকে আটক করে। পুলিশের প্রশ্নের জবাবে প্রথমে জল বের করার নালা বানাতেই সে গর্ত খুঁড়েছিল বলে জানায় বিশ্বনাথ।

পুলিশ তাকে তুলে নিয়ে যায় থানায়। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে সে মাকে খুনের কথা কবুল করে। বিকেলে পুলিশ বিশ্বনাথকে ফের বাড়িতে নিয়ে আসে। ঘটনাস্থলে ম্যাজিস্ট্রেট বিমলাপ্রসাদ সিংহবাবুকে সঙ্গে নিয়ে আসেন জেলা পুলিশের ডিএসপি (প্রশাসন) আনন্দ সরকার, ডিএসপি ( আইনশৃঙ্খলা) বাপ্পাদিত্য ঘোষ, বাঁকুড়া সদর থানার আইসি রাজর্ষি দত্ত-সহ পুলিশ আধিকারিকেরা। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই মায়ের দেহ পুঁতে ফেলা জায়গা চিহ্নিত করে বিশ্বনাথ। অন্তত পাঁচ ফুট গর্ত খোঁড়ার পরে বেরিয়ে আসে মণিদেবীর দেহ। পুলিশের কাছে সে বলতে থাকে, “আমি খুন করিনি। মা নিজেই মারা গিয়েছে।’’

মায়ের উপর এত রাগ কেন?

এ প্রশ্ন শুনে বিশ্বনাথ বলে, “যতই নিষেধ করি মা সেই এ-দিক ও-দিক চলে যেত। তাই নিয়েই আমার সঙ্গে ঝগড়া করত।’’ রাতে পরিবারের তরফে বাঁকুড়া থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement