জল নিতে বাইরে লাইন। ভিতরে ওটির কলেও জল নেই। রবিবার বিকেলে সুজিত মাহাতোর তোলা ছবি।
৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু জল আসেনি পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে।
শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে শুধু যে এই হাসপাতালই নির্জলা তা নয়, হাসপাতাল লাগোয়া নার্সেস হস্টেল, হাসপাতালের কর্মীদের আবাসন-সহ সর্বত্র এক অবস্থা। পানীয় জলের সঙ্গে নিত্য ব্যবহারের জলও মিলছে না। এর ফলে হাসপাতাল চত্বরে জলের জন্য হাহাকার পড়ে গিয়েছে। জলের সঙ্কটে গোটা হাসপাতাল নারকীয় অবস্থায় পৌঁছেছে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, পাইপ লাইনে জল না এলেও পুরসভা দু’বেলা গাড়ি পাঠিয়ে জল সরবরাহ করছে। কিন্তু তা যে চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট কম, তা মানছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও। রোগীর পরিজনদের অভিযোগ, জলের গাড়ি রয়েছে জরুরি বিভাগের কাছে। সেখান থেকে বালতিতে করে রোগীর জন্য কখনও তিনলায়, কখনও বা চারতলায় পর্যন্ত ওয়ার্ডে জল বয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। এতে পরিশ্রমও বেশ হচ্ছে।
রবিবার বিকেলে নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পানীয় জল নিতে নেমেছিলেন এক মহিলা। তিনি বলেন, ‘‘ও একা ওয়ার্ডে থাকতে চাইছে না। তাই কোলে নিয়েই নেমেছি। জলের ভারী বালতি বয়ে নিয়ে ওয়ার্ডে ফিরতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি-ই বা করার আছে।’’
জলের গাড়ি এলেই লম্বা লাইন পড়ে যাচ্ছে। জল ভরছিলেন পুরুলিয়া ১ ব্লকের ভান্ডারপুয়াড়া গ্রামের সন্ধ্যা মাহাতো। তাঁর কথায়, ‘‘আমার বৌমা প্রসূতি বিভাগে ভর্তি আছে। শুক্রবার রাত থেকে জলের ব্যবস্থা করতে কী যে ঝকমারির মধ্যে পড়তে হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না।’’ বাঘমুণ্ডির মাদলা গ্রামের কার্তিক কুমারের স্ত্রী ভর্তি রয়েছেন ‘ফিমেল মেডিক্যাল’ ওয়ার্ডে। কার্তিকবাবুই স্ত্রীর জন্য তিনতলায় জল বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘‘কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! জলের জন্য মারামারি না বাধে।’’ পুরুলিয়া ১ ব্লকের মাহালিতোড়া গ্রামের বাসুদেব মাহাতো বা রঘুনাথপুরের পুটু কুণ্ডু— সকলেরই এক অবস্থা। বাসুদেববাবু বলছিলেন, ‘‘জল নেই। ফলে হাসপাতালের শৌচাগারের যা অবস্থা, নরক বললেও কম বলা হয়।’’
হাসপাতালের এই অবস্থা বলে ছেলেকে নিয়ে রবিবার দুপুরেই বাড়ি ফিরে যান পুরুলিয়া শহরের কেতিকা এলাকার বাসিন্দা ঝর্না বাউরি। তিনি ছেলে রাহুলের জ্বর হওয়ায় তাকে ভর্তি করেছিলেন। কেন হাসপাতাল ছাড়লেন? তাঁর কথায়, ‘‘হাসপাতালের যা পরিস্থিতি, সেখানে আরও কিছুদিন থাকলে ছেলে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে।’’
এ দিকে জলের জন্য অপারেশন চালানোও বেশ চাপের হয়ে পড়েছে। কর্মীরা বাইরে থেকে জল এনে অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) ট্যাঙ্কে ঢালছেন। তাতে কোনওরকমে কাজ চালানো হচ্ছে। তবে রবিবার বিকেলে সেই ট্যাঙ্কের জলও ফুরিয়ে যায়। এক নার্স তা দেখে আঁতকে উঠে বলেন, ‘‘এক ফোঁটাও জল নেই! কী ভাবে ওটি চলবে? এক্ষণই গর্ভবতী মহিলার অস্ত্রোপচার রয়েছে। এ দিকে, ওয়ার্ড মাস্টারকে সমস্যার কথা জানালে তিনি জানাচ্ছেন, আমাদেরই ওটিতে জল বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমরা কী ভাবে পারব?’’
একই দুরবস্থা হাসপাতালের পাশে নার্সেস হস্টেলেও। হস্টেলের নার্সদের অভিযোগ, শুক্রবার রাত থেকে জল নেই। দুর্বিষহ অবস্থা চলছে। একে তো আবাসনে জল নেই, তার উপরে ওয়ার্ডের অবস্থাও এমনই যে তাঁদের বসে ডিউটি করতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। এক নার্সের কথায়, ‘‘দ্রুত জলের সঙ্কট না মিটলে আমরাই অসুস্থ হয়ে পড়ব।’’
৫৩০ শয্যার হাসপাতালে রবিবার রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৩০। হাসপাতালের সহকারী সুপার শান্তনু মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এই সমস্যা হাসপাতালের নয়, পুরসভাই হাসপাতালে জল পাঠাতে পারছে না। ফলে হাসপাতালের ১৪টি ওয়ার্ড-সহ সর্বত্রই সমস্যা দেখা দিয়েছে।’’
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, হাসপাতালে প্রতিদিন জলের চাহিদা ৪০ হাজার গ্যালন। কিন্তু শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কংসাবতী নদীর যেখান থেকে জল তোলা হয়, সেখানে বিদ্যুতের লাইনে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে। তাতেই এই বিপত্তি। পুরসভার জল সরবরাহের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক পার্থসারথি সেনগুপ্তর কথায়, ‘‘শুক্রবার দুপুরে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়। তারপর থেকেই মাটির নীচে থাকা কেব্ল লাইনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু আমরা কোথাও সমস্যা খুঁজে পাচ্ছি না।’’
কমবেশি দেড় কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মাটির নীচে কেব্ল পাতা রয়েছে। সেই লাইনে গণ্ডগোল খুঁজতে পুরসভা বিদ্যুৎ দফতরের সাহায্য নিচ্ছে। কিন্তু রবিবার বিকেল পর্যন্ত কোথায় সমস্যা তা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এক জায়গায় সমস্যা খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল শনিবার। মেরামত করে জল তুললেও মিনিট কুড়ি পরে ফের সমস্যা দেখা দেয়। ফলে সঙ্কট মোচন কবে, তাকিয়ে সবাই।