টাকা দিয়েও নির্মল হয়নি শহর

এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। ঢাকঢোলে পিটিয়ে দেশজুড়ে প্রচার চলছে স্বচ্ছ ভারত মিশনের, এ রাজ্যে নির্মল বাংলার। কেন্দ্রীয় ওই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে শৌচাগার বানিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মানুষকে। যাতে উন্মুক্ত স্থানে শৌচ কর্ম করার অভ্যাস ত্যাগ করেন গ্রামের মানুষ।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০০:২৮
Share:

কবে মিলবে শৌচাগার? উত্তরের প্রতীক্ষায় শীলা দাস। —নিজস্ব চিত্র।

এ যেন প্রদীপের নিচেই অন্ধকার। ঢাকঢোলে পিটিয়ে দেশজুড়ে প্রচার চলছে স্বচ্ছ ভারত মিশনের, এ রাজ্যে নির্মল বাংলার। কেন্দ্রীয় ওই প্রকল্পের অঙ্গ হিসাবে বাড়িতে বাড়িতে শৌচাগার বানিয়ে তা ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে মানুষকে। যাতে উন্মুক্ত স্থানে শৌচ কর্ম করার অভ্যাস ত্যাগ করেন গ্রামের মানুষ। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে নির্মল গ্রাম গড়ে জল দূষণ আটকাতে এবং বাড়ির মহিলাদের সম্ভ্রম বজায় রাখার উদ্যোগের জন্যই একটার পর একটা পঞ্চায়েত নির্মল ঘোষিত হচ্ছে যখন, ঠিক তার উল্টো ছবি দেখা দিল জেলার দুবরাজপুরে। তথ্য বলছে, চল্লিশ বছর আগে প্রাচীন এই গঞ্জশহর পুরসভার তকমা পাওয়ার পরও শহরের অন্তত ৩০ শতাংশ বাড়িতেই শৌচাগার নেই!

Advertisement

এ শহরের ওয়ার্ড রয়েছে ১৬টি। পুরসভায় বাসিন্দা প্রায় ৪০ হাজার। যে ওয়ার্ডগুলিতে সবচেয়ে করুন অবস্থা, সেগুলি হল ৩, ৭, ৮, ৯, ১০, ১১। যেগুলির কোনওটিতে ৭০ শতাংশ বাড়িতেই শৌচাগার নেই, কোথাও ৫০ শতাংশ বাড়িতে নেই! অবস্থা ততটা খারাপ না হলেও ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বহু পরিবারেই শৌচাগার নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, দুবরাজপুর মূলত গ্রাম্য শহর। পুরসভার তকমা পেলেও অনেককিছুই গ্রামের মতোই। যেমন এখানে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া বহু পরিবারেই শৌচাগার নেই। আবার খানিকটা গ্রাম্য মানসিকতার জন্য অনেক পরিবারে শৌচাগার থাকলেও তা কম ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে সচেতনতা বাড়ানো বা বাড়িতে বাড়িতে শৌচাগার তৈরির তেমন উদ্যোগ গৃহীত হয়নি পুরসভার তরফে। এমনটাই মত এলাকার মানুষের। তাঁদের মিলিত প্রশ্ন পুরসভায় এমনটা কেন হবে? কেন বাড়িতে শৌচাগার থাকবে না? সকাল বিকাল পুকুর ও উন্মুক্ত জায়গাই কেন ভরসা হবে মানুষের?

যে ছবি অনেক গ্রামকেও লজ্জায় ফেলবে, সেই ছবি যাতে দেখতে না হয়, সে নিয়ে সরব মানুষ।

Advertisement

পুরসভায় বসবাসকারি সচেতন মানুষেরা বলছেন, সকাল সন্ধ্যায় পুর সভার বিভিন্ন ওয়ার্ডের পুকুর পাড়ে বা খোলা জায়গায় মল ত্যাগের যে দৃশ্য দেখা যায়, তা যেমন পুর সভার গৌরব বাড়ায় না তেমনই জলদূষণের আশঙ্কা থেকেই যায়। বিশেষ করে বর্ষা কালে। পুরসভা বলছে ওই প্রকল্প গ্রামের শৌচাগার গড়ার জন্য হলেও শহরের জন্য তা নয়। শহরের শৌচাগার কারার জন্য রয়েছে ইন্টিগ্রেটেড লো কস্ট সেনিটেশন সংক্ষেপে আইএলসিএস। কিন্তু দুবরাজপুরের সেই প্রকল্প এখনও কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি।

বরং ওই প্রকল্পে শৌচাগার বানিয়ে দেব বলে ইচ্ছুক ১৩৮৭ টি পরিবারের কাছ থেকে বছর দুয়েক আগেই ১৫০০ টাকা কার নেওয়ার পর বিপাকে পুরসভা। পুরপ্রধান বলছেন বরাদ্দ এখনও আসেনি। যে সব পরিবার শৌচাগার বানাতে টাকা দিয়েছেন, তাঁরা জানতে চাইছেন কবে তাঁদের বাড়িতে শৌচাগার হবে। কোনও সদুত্তর আমাদের কাছে নেই। পুর প্রধানের মতোই একই দাবি করছেন ১০ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলর আলাউদ্দিন খান, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর বিপ্লব মাহাতা, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ নাজিরউদ্দিনও।

পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে ২০১৩ সালে পুর ভোটের আগেই কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অধীনস্থ শহরের ২৩০০টি শৌচাগার নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছিল। কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল পুরভোটের পর থেকেই। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা যে সব পরিবার গুলিতে শৌচাগার নেই, বা যে সব বাড়িতে ড্রাই টয়লেট ছিল সেই সব বাড়ির চিহ্নিত করে উন্নত মানের শৌচাগার নির্মাণ করা

সমতলে প্রতি শৌচাগারের জন্য খরচ বরাদ্দ ১৫ হাজার টাকা। যদিও পাহাড়ি এলাকায় বরাদ্দ আরও ২৫ শতাংশ বেশি। মোট বরাদ্দের ৭৫ শতাংশ দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। ১৫ শতাংশ রাজ্য সরকার। এবং উপভোক্তা দেবে মোট বরাদ্দের ১০ শতাংশ। নিয়ম অনুযয়ী এনজিওর মারফৎ শৌচাগার গুলি নির্মিত হওয়ার কথা। এখানে ১৫০০ টাকা।

পুরপ্রধান বলেন, ‘‘সেই সূত্রেই রসিদ কেটে ওই পরিবারগুলি থেকে টাকা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বরাদ্দ এখনও আসেনি।’’ পুরসভার একমাত্র বিরোধী দল সিপিএম কাউন্সিলর আলাউদ্দিন বলছেন, ‘‘আমার ওয়ার্ডের প্রায় ২৫০টির বেশি পরিবার টাকা জমা দিয়েছিলেন। বিরক্ত হয়ে তাঁরা বলছেন যদি কাজই হবে না তাহলে টাকা নিলে কেন। পুরসভা বলছে কেন্দ্র টাকা দেয়নি’’ তাঁর দাবি, ‘‘রাজ্য সরকার নিজেদের অংশ দিয়েছে কী? সেটাও তো জানা নেই, বরাদ্দ পাওয়ার জন্য পুরসভা ঠিক কী পদক্ষেপ নিয়েছে সেটাও জানতে পারছি না।’’

ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরেও টাকা দেওয়ার পরও কেন তাঁদের বাড়িতে শৌচাগার হল না, সেই ক্ষোভের একটা আঁচ পাওয়া গেল। তিন নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা রামপ্রসাদ দাস ও স্ত্রী শীলা দাস বাড়িতে তিনজন মহিলা ও দুই শিশু মিলিয়ে ৯ জনের পরিবার। তাঁরা জানালেন, ‘‘প্রতিদিন সকাল বিকাল কষ্ট করে পুকুরে যেতে হয়। বর্ষার সময় কারও শরীর খারাপ হয়ে গেলে কী অসুবিধা বোঝানো যাবে না। শৌচাগার গড়তে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু হল না।’’

একই দাবি ১০ নম্বর ওয়ার্ডের শেখ গোলাম খাজা ও তাঁর স্ত্রী মমতাজ বিবির। বললেন, ‘‘দুটি বাচ্চা স্বামী স্ত্রী নিয়ে সংসার। বাড়িতে শৌচাগার না থাকায় প্রায় আধ কিমি দুরের পুকুরে যেতে হয়। বাচ্চাগুলিকে রাতের বেলায় কোথায় নিয়ে যাব? পুরসভার নর্দামাই তখন ভরসা। কবে আমাদের দুর্দশা ঘুচবে?’’

নিরুত্তর দুবরাজপুর পুরসভা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement