এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না নেহার পড়শিদের!
বাড়ির পাশের ছোট্ট মেয়েটাকে এই সেদিনও তো খেলতে দেখেছেন তাঁরা। এই সেদিনও, স্কুল যেতে দেখেছেন এক রত্তির মেয়েটাকে। হঠাৎ করেই এক মাস আগে তার উধাও হয়ে যাওয়া আর বুধবার তার পচাগলা দেহ উদ্ধারের পর তাঁদের কাছে সব দেখা-না-দেখার অর্থই বদলে গিয়েছে। তাঁরা ভেবেই শিউরে উঠছেন, পড়শি মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করেছে তাঁদের গ্রামেরই কয়েকজন ছেলে!
ঠিক কী হয়েছিল এতক্ষণে জেনে গিয়েছে নেহার গ্রাম গোয়ালমাল। জেনে গিয়েছে, খুনের আগে ও পরের ঘটনাক্রম। এক মাস পাঁচ দিন আগে নেহাকে পাড়ারই এক দাদা জুবের সেখ ডেকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের চৈত্র সংক্রান্তির মেলা দেখাতে। এরপর জুবের সেখ গ্রামের আর এক দাদা রাজ সেখের মাধ্যমে সে পৌঁছে গিয়েছিল এলাকার আর এক দাদা বাচ্চুসেখের কাছে। ততক্ষণে গ্রামের জামাই রুকু সেখের ছক মাফিক বাচ্চুসেখ, রাজ সেখ এবং জুবের সেখ মেলা দেখানোর নাম করে আইসক্রিম খাইয়েছে। এক রত্তির নেহা আর কি করে জানবে ওই আইসক্রিমে নেশার ওষুধ মেশানো রয়েছে!
নেহা অপহরণের পর গ্রামে রটে গিয়েছিল যে সে মেলা দেখতে গিয়েছিল। সেখানে তাকে কে বা কারা অপহরণ করে মোবাইলে মুক্তি পণ বাবদ পাঁচ লক্ষ টাকা দাবি করেছে। তার আগে গ্রামের মেলার মাইকে সন্ধ্যায় প্রচার করা হয় নেহা খাতুন নামে একটি সাত বছরের মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু অপহরণের ফোন আসতেই চমকে ওঠে গ্রামবাসীরা। আতঙ্ক ছড়াতে থাকে গ্রামে। নেহার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়ায়। বুধবার দুপুরে দেহ উদ্ধারের পর সংবাদমাধ্যমের দৌলতে নেহার গ্রাম জেনে গিয়েছে, নিছক অপহরণ নয়। সালকিয়ার মতোই অপহরণের ছক মুরারইয়ে!
গ্রামের বাসিন্দা নজরুল সেখ, মহম্মদ আব্দুল সেখদের দাবি, ‘‘ভেবেছিলাম, আমাদের মেয়েকে অন্তত জীবিত অবস্থায় পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতীক্ষাই সার হল!’’
গত ১৫ এপ্রিল অপহরণ করা হয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী নেহাকে। ওই রাতেই তার বাবা মুসা খানের কাছে ৫ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসে। ১৭ তারিখ মুরারই থানায় অভিযোগ করেন তিনি। অভিযোগপত্রে কোন নম্বর থেকে মুক্তিপণের ফোন এসেছিল, তা-ও উল্লেখ করেন। পাশাপাশি, তিনি জানান, ওই ফোন বাচ্চু করেছে বলে তাঁর সন্দেহ। অভিযোগ, এর পরেও পুলিশ তদন্তে গাফিলতি দেখাতে থাকে। ২২ এপ্রিল বাচ্চুকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু, চার দিন আটক রাখার পরেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে তাকে ছাড়া হয়। ঘটনা হল, পুলিশের ভূমিকা নিয়ে সরব হয়েছেন নেহার পড়শিরা।
পুলিশ ইতিমধ্যেই বাচ্চু শেখ ও বকুল শেখ নামে গ্রামেরই দুই যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জেরা করেই গ্রামের অদূরে খালে নেহার দেহ মেলে। এবং আরও এক সন্দেহভাজন বকুল শেখকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশের দাবি, জেরার মুখে বাচ্চু কবুল করে সে ও কয়েক জন মিলে টাকার লোভ নেহাকে অপহরণ করেছিল। সেই রাতেই শিশুটিকে তারা শ্বাসরোধ করে মারে। পুলিশের দাবি, গোটা অপহরণ-কাণ্ডের মাথা মালদহের সুজাপুরের বাসিন্দা, বছর চল্লিশের এক যুবক। তাকে পুলিশ মুম্বই থেকে আটক করে এনেছে। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, দেহ উদ্ধারে এত দিন সময় লাগল কেন?
দিন দুই থেকে গ্রামের কারও কারও কাছে খবর আসে নেহাকে খুন করা হয়েছে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, ‘‘পাঁচ বছর ধরে মালদহ সুজাপুরে বাসিন্দা রুকু সেখ গোয়ালমাল গ্রামে নতুন বাড়ি করে রয়েছেন। পেশায় সামান্য রাজমিস্ত্রি হয়ে রুকু সেখের পাকা দোতলা বাড়ি দেখে অনেকের সন্দেহ হয়। রুকু গ্রামে জাল নোটের কারবার থেকে নকল সোনার ব্যবসা করত। নেহাকে অপহরণের মাথা ছিল সেই।’’
রামপুরহাট এসডিপিও জোবি থমাস কে বলেন, ‘‘পুরো ঘটনার মাথা রুকু সেখকে পুলিশ আগেই আটক করেছিল। এছাড়া জুবের সেখ, রাজ সেখ নামে দু’জন নাবালককেও পুলিশ আটক করেছিল। বুধবার মৃতদেহ উদ্ধার করার পর রুকু সেখ, জুবের সেখ ও রাজ সেখকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনায় আরও কয়েকজন জড়িত আছে তাদেরকে খুঁজছে পুলিশ।’’ পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বকুলের আগেই চোদ্দ দিনের জেল হেফাজত হয়েছে। বাচ্চুকে পাঁচদিনের পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার পর লাগাতার জিজ্ঞাসাবাদের পর বাচ্চুর কাছ থেকে রুকু সেখ, জুবের সেখ, রাজ সেখ-সহ আরো কয়েকজনের নাম মিলেছে। বুধবার তাঁকে আদালতে পাঠানো হলে, আদালত বাচ্চুর ১৪ দিনের জেল হাজতের নির্দেশ দেয়। ধৃত দুই নাবালককে বৃহস্পতিবার সিউড়িতে জুবিনাইল আদালতে পাঠানো হয়।
নেহার অপহরণের পর অনেক অভিভাবকই তাঁদের ছোট ছেলে মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। গোয়ালমাল গ্রামের জুনিয়র হাই স্কুলের টিচার ইনচার্জ কিশোর নন্দী বলেন, ‘‘ঘটনার পর থেকেই স্কুলে অনেকেই পড়ুয়াদের পাঠাতে ভয় পাচ্ছিল। কয়েকজন অভিভাবক তাঁদেরকে স্কুল শুরুর সময় দিয়ে যাচ্ছিলেন এবং স্কুল ছুটির পর স্কুল থেকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। তাতে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু বুধবার যে অবস্থায় মৃতদেহটি উদ্ধার হয়, তাতে আবার একটা আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।’’ একই কথা শোনালেন নেহার গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধাণ শিক্ষক জগন্নাথ মাল। ‘‘নেহা মেয়েটা শান্ত স্বভাবের ছিল। লেখাপড়ায় ভাল ছিল। ওর অপহরণের পর স্কুলে ১০ শতাংশ হাজিরা কমে গিয়েছে।’’
ছোট্ট মেয়েটার শোক ও স্মৃতিতে কার্যত গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। তার দেহ উদ্ধারের পর আতঙ্ক ক্রমশই গ্রাস করে নিয়েছে পরিবার, পড়শি থেকে তার খুদে বন্ধুমহলেও। সে কথাই বলছিলেন এক অভিভাবক, পূর্ণেন্দু সাহা। বললেন, ‘‘দুটি স্কুল রয়েছে গ্রামে। গ্রামের বাইরে হাইস্কুল আছে। সেখানে ছেলেমেয়েরা যেতে ভয় পাচ্ছে এখনও।’’ এভাবে নেহার দেহ মিলবে, সেটাই এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না কেউ কেউ! কোন ভরসায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাবেন, সেটাই জিজ্ঞাসা তাঁদের।
নেহার এক বন্ধুর বাবা মনিরুদ্দিন আলি বলছিলেন সে কথা। ‘‘নেহার সঙ্গে আমার মেয়ে স্কুলে খেলত। নেহা আমাদের বাড়িতেও খেলতে আসত। সত্যি কি জানেন, ঘটনার পর থেকেই মেয়েটা স্কুল যেতে চাইছে না! নিজের মনে হচ্ছে, কি অপরাধ করেছিল একরত্তির নেহা!’’