প্রায় ফাঁকা স্কুল। — ফাইল চিত্র।
জঙ্গলমহলের অন্যতম প্রান্তিক জেলা পুরুলিয়ায় কি পাঁচশোর বেশি স্কুলে তালা ঝুলতে চলেছে! সমাজ মাধ্যমে ‘ভাইরাল’ হওয়া একটি তালিকা ঘিরে এমনই আশঙ্কা দানা বেঁধেছে শিক্ষক সংগঠনগুলির মধ্যে। তিরিশের কম পড়ুয়া রয়েছে, বিভিন্ন জেলার এমন ৮,২০৭টি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুলের নাম রয়েছে তালিকায়। সেখানে রয়েছে পুরুলিয়ার ৫৭৮টি প্রাথমিক ও ১১৬টি উচ্চ প্রাথমিক বাজুনিয়র হাই স্কুলও।
প্রশ্ন উঠছে, কম পড়ুয়া থাকায় ওই স্কুলগুলি কি বন্ধ করে দেওয়া হবে! জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান রাজীবলোচন সরেনের তবে দাবি, “এই মর্মে রাজ্য শিক্ষা দফতরের তরফে কোনও নির্দেশিকা আসেনি। তিরিশ জনের কম পড়ুয়া রয়েছে জেলায় এমন কতগুলি প্রাথমিক বা উচ্চ প্রাথমিক স্কুল রয়েছে, সেই তালিকা জেলার কাছে চাওয়া হয়েছে মাত্র। তা পাঠানোও হয়েছে।” বিষয়টি স্বীকার করলেও এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি জেলা শিক্ষা দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক।
নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা সম্পাদক নিলয় মুখোপাধ্যায়ের বলেন, “তালিকাটি চোখে পড়েছে। আমাদের আশঙ্কা, স্কুলগুলি হয়তো বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের হবে। স্কুলে পড়ুয়া কম থাকলে তার জন্য তো শিক্ষক-শিক্ষিকারা দায়ী নয়। হয়তো পরিকাঠামো সেখানে ভাল। তবে পড়ুয়ার নিরিখে শিক্ষক-শিক্ষিকা যথেষ্ট নয়। তাই অভিভাবকেরা সন্তানকে অন্য স্কুলে পাঠাচ্ছেন। আমাদের দাবি, কোনও স্কুল বন্ধ করা যাবে না।” তিনি জানান, তাঁদের সংগঠন রাজ্য জুড়ে দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামছে। জেলা শিক্ষা দফতরে স্মারকলিপিও দেওয়া হবে।
পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক সুধণ্বা মাহাতো জানান, শিক্ষার অধিকার আইন, ২০০৯ অনুযায়ী গ্রামীণ এলাকায় ১ কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক ও ৩ কিলোমিটারের মধ্যে উচ্চ প্রাথমিক স্কুল থাকতে হবে। শহরাঞ্চলে তা যথাক্রমে পাঁচশো মিটার ও দুই কিলোমিটার। তাঁর কথায়, “আমাদেরও আশঙ্কা, তালিকার স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তিরিশের কম পড়ুয়া রয়েছে, এই অজুহাতে যদি পুরুলিয়ার মতো জেলার এত স্কুল বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে শিক্ষার অধিকার আইন লঙ্ঘিত হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।” ২০১০-এ ঝালদা ১ ব্লকের ঝালদা-দঁড়দা পঞ্চায়েতের যে এলাকায় মাওবাদী হানায় একাধিক প্রাণহানি হয়, সেই এলাকার বরুয়াকোচা জুনিয়র হাই স্কুলের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “এক জন শিক্ষক নিয়ে বরুয়াকোচা জুনিয়র হাই স্কুল চলছে। অভিভাবকেরা স্বভাবতই মুখ ফেরাচ্ছেন। পড়ুয়া কমছে। ওই ব্লকে শুধু বরুয়াকোচা নয়, এমন একাধিক স্কুল রয়েছে।”
বিজেপির প্রাথমিক শিক্ষা সেলের জেলা সভাপতি শুভেন্দু দত্তের প্রতিক্রিয়া, “শিক্ষা ব্যবস্থা বা পরিকাঠামো দুর্বল হতে পারে, এমন কোনও সিদ্ধান্ত মানা হবে না। জয়পুর ব্লকের উপরকাহান জুনিয়র হাই স্কুলে যেমন তিনশোর উপরে পড়ুয়া রয়েছে। আগে চার জন শিক্ষক ছিলেন। তিন জন অন্যত্র বদলি নিয়ে চলে গিয়েছেন। এর জন্য দায়ী কে! ভাইরাল হওয়া তালিকার বিষয়টি জানি। মাধ্যমিকের পরে এ নিয়ে আমরা আন্দোলনে নামব।”
জেলা তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিমলকান্ত মাহাতো বলেন, “এটা সত্যি যে শিক্ষা দফতরের এমন একটি তালিকা সমাজ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা শিক্ষা দফতরের কাছে জানতে চেয়েছি। দফতর জানিয়েছে, এই মর্মে কোনও নির্দেশ রাজ্য শিক্ষা দফতরের তরফে আসেনি। আমরা আমাদের আপত্তির কথা সংশ্লিষ্ট মহলেও জানিয়েছি।”
তালিকায় বাঁকুড়ারও মোট ৮৮৬টি স্কুল রয়েছে। এর মধ্যে ৮১১টি প্রাথমিক ও ৭৫টি উচ্চ প্রাথমিক স্কুল। জেলার বিভিন্ন স্কুলগুলিতে পড়ুয়ার তুলনায় শিক্ষক কম থাকা নিয়ে মাঝেমধ্যে চর্চা হলেও এর উল্টো ছবিও রয়েছে। হাটআশুড়িয়া জুনিয়র গার্লস হাই স্কুল যেমন ১৭ জন ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষিকা সেখানে চার জন। বড়জোড়ার সীতারামপুর প্রাথমিক স্কুলে ন’জন পড়ুয়া ও দু’জন শিক্ষক রয়েছেন। বিষ্ণুপুরের হেতাগোড়া জুনিয়র হাই স্কুলেও পড়ুয়ার সংখ্যা মাত্র তিন। খোদ জেলা শহর বাঁকুড়ায় এমন স্কুলের সংখ্যা কম নয়। বাঁকুড়া সদর পশ্চিম চক্রের যুগীপাড়া ডিএম প্রাথমিক বিদ্যালয় ও শহিদ ক্ষুদিরাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া রয়েছে দু’জন করে। দু’টি স্কুলেই শিক্ষক রয়েছেন দু’জন করে। এমন বহু স্কুল বাকি দুই পুরশহর, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখীতেও রয়েছে।
এবিপিটি-এর বাঁকুড়া জেলা সম্পাদক বিমান পাত্র বলেন, “বাম আমলে বিভিন্ন গ্রামে পড়ুয়াদের চাহিদামতো পরিকল্পনা করে স্কুলগুলি তৈরি হয়েছিল। সেগুলি বন্ধ করার চেষ্টা হলে তা আমরা মানব না। আমাদের দাবি, সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে প্রাথমিক স্কুলের পরিকাঠামো আরও উন্নত করা হোক। যাতে পড়ুয়ারা সেখানে পড়তে আগ্রহী হয়।”
জেলা তৃণমূল প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি গৌতম গরাই বলেন, “পড়ুয়া কম থাকা স্কুলগুলির জন্য কী পরিকল্পনা রয়েছে দফতরের, তা নিয়ে কোনও নির্দেশিকা আসেনি। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করব না।” শিক্ষক মহলের একাংশের তবে অনুমান, বন্ধ করা নয়, কম পড়ুয়া থাকা স্কুলগুলিকে অন্য স্কুলের মিশিয়ে দিতে পদক্ষেপ হতে পারে।