ফাইল চিত্র।
শিল্পায়নে রঘুনাথপুরকে পাখির চোখ করার কথা পুরুলিয়া সফরে এলেই মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এক মাস আগে রঘুনাথপুর শিল্পতালুক তথা ‘জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরী’-তে লগ্নির জন্য ফাউন্ড্রি শিল্পকে আহ্বান জানিয়েছেন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী শশী পাঁজা। তারপরেই রঘুনাথপুরে শ্যাম স্টিলের নির্মীয়মাণ সুসংহত ইস্পাত কারখানা পরিদর্শন করে বিধানসভার শিল্প-বাণিজ্য স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান কানাইচন্দ্র মণ্ডলও দাবি করেন, রাজ্যের শিল্প মানচিত্রে ক্রমশই দিশারী হয়ে উঠছে রঘুনাথপুর। এই ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে শাসকদল দাবি করছে মুখ্যমন্ত্রীর আবেদন মেনে রঘুনাথপুরে জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরীতে ক্রমশই বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে বড়মাপের শিল্প সংস্থাগুলি।
পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রঘুনাথপুরে শিল্পায়নের কর্মকাণ্ড শুরু হলেও রাজ্যে পালাবদলের পরে এখানে শিল্পে খরা পরিস্থিতি তৈরি হয়। তবে তৃণমূল তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে এখানকার শিল্প পরিস্থিতি বদলাচ্ছে।
রঘুনাথপুর ১ ব্লকের নতুনডি পঞ্চায়েতের লছমনপুরে বড় বিনিয়োগ করে সুসংহত ইস্পাত কারখানা গড়েছে শ্যাম স্টিল। শাকম্ভরী গ্রুপ সাঁতুড়ির একটি বন্ধ কারখানা অধিগ্রহণ করে নতুন ইস্পাত কারখানা গড়ে তুলেছে। নিতুড়িয়ার দীঘা পঞ্চায়েত এলাকায় বড় সিমেন্ট কারখানা গড়ছে শ্রী সিমেন্ট।
২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী জঙ্গলসুন্দরী কর্মনগরী নামের শিল্পনগরী তৈরির কথা ঘোষণা করেন। কর্মনগরীর পরিকাঠামো তৈরিতে বাজেটে ১০০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করার দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘটনাচক্রে তারপরেই সাঁতুড়ির বালিতোড়া পঞ্চায়েত এলাকায় বন্ধ হওয়া স্পঞ্জ আয়রন কারখানা অধিগ্রহণ করে নতুন ইস্পাত কারখানা গড়ে তোলে শাকম্ভরী গ্রুপ। ওই শিল্প সংস্থার দাবি, ইতিপূর্বে নিতুড়িয়া ও পাড়ায় দু’টি ইস্পাত কারখানা চালু করেছে তারা।
সংস্থার মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের গ্রুপ হেড মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় জানান, সাঁতুড়ি ব্লকে তাঁরা একটি বন্ধ কারখানাকে অধিগ্রহণ করেছেন। ইতিমধ্যে ১২০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে সেখানে উৎপাদন শুরু করা হয়েছে। এ বার সেই কারখানার সম্প্রসারণের জন্য আরও ২৮০ একর জমিতে ৩,৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চলেছেন তাঁরা। সম্প্রতি সেই কাজে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে জনশুনানি করা হয়।
বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রঘুনাথপুর ১ ব্লকে সুসংহত ইস্পাত কারখানার জন্য জমি নিয়েছিল শ্যাম স্টিল। রাজ্যে পালাবদলের পরে সেই জমি তারা রাজ্যকে ফিরিয়ে দেয়। তৃতীয়বারের জন্য তৃণমূল ক্ষমতায় ফেরার পরে সেই লছমনপুরেই ইস্পাত কারখানা গড়তে ৬০০ একর জমি রাজ্যের শিল্প উন্নয়ন নিগমের কাছ থেকে কিনেছে সংস্থাটি। শ্যাম স্টিলের ডিজিএম (কর্পোরেট অ্যাফায়ার্স) সিদ্ধার্থ পান্ডে বলেন, ‘‘৬০০ একর জমিতে সুসংহত ইস্পাত কারখানা গড়া হচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেখানেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানা গড়া হবে।’’ তৃণমূলের আমলেই নিতুড়িয়ার দীঘা পঞ্চায়েত এলাকায় ৭০ একর জমি কিনে বড় সিমেন্ট কারখানা গড়ার কাজ শুরু করেছে শ্রী সিমেন্ট। সিমেন্টে ভিন্ রাজ্যে বড়মাপের বিনিয়োগ করা ওই সংস্থার এ রাজ্যে প্রথম বিনিয়োগ এই নিতুড়িয়াতেই।
রাজ্য সরকারের শিল্পবান্ধব মনোভাব ও শিল্প স্থাপনে প্রশাসনের সদর্থক ভূমিকার জন্যই তারা এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়েছেন বলে জানাচ্ছে সংস্থাগুলি। শাকম্ভরী গ্রুপের অন্যতম শীর্ষ আধিকারিক মৃত্যুঞ্জয় চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জমি থেকে জল, বিদ্যুৎ পেতে কিংবা কারখানায় ছোটখাট সমস্যা হলে, সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনের সহযোগিতা পাওয়া যায়।” তিনি জানান, শিল্পস্থাপনে অনুমোদন পেতে দীর্ঘসূত্রিতা হলে সংস্থাগুলি বিনিয়োগে আগ্রহ হারায়। এখন অনুমোদন দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া প্রতি মাসে জেলাশাসক নিজে বৈঠক করে শিল্প সংস্থাগুলির সমস্যা জেনে সমাধানের ব্যবস্থা করছেন। সেই বৈঠকে থাকছেন পুলিশের পদস্থ কর্তারাও। সব মিলিয়ে পুরুলিয়ার সমস্ত মহলেই শিল্পবান্ধব পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
শ্যাম স্টিলের ডিজিএম সিদ্ধার্থ জানাচ্ছেন, আবেদনের পরেই দ্রুত তাঁদের এক লপ্তে ৬০০ একর জমির ব্যবস্থা করে দেয় রাজ্য শিল্প উন্নয়ন নিগম।
তিনি বলেন, ‘‘৬০০ একর জমি কিনে কারখানা গড়তে সাধারণত তিন-চার বছর লেগে যায়। সেখানে রাজ্যের শিল্পবান্ধব মনোভাব ও শিল্প উন্নয়ন নিগমের সদর্থক ভূমিকায় দ্রুত জমি পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের সহযোগিতায় কারখানার জমিতে পাঁচিল তৈরির ৮০ শতাংশ কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে।’’ (চলবে)