লাভপুরের অন্যতম আকর্ষণ ফুল্লরা মন্দির। নিজস্ব চিত্র ।
দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি এলাকায় নির্বাচনী সভা করে গিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তাই এ বার বোলপুর লোকসভা আসনের আওতায় থাকা লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রের লড়াই তৃণমূল ও বিজেপির কাছে সম্মানরক্ষার প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সামগ্রিক ফলাফলের নিরিখে শেষ হাসি তৃণমূলই হেসেছে। ভোট-পরিসংখ্য়ান বলছে, শুধু লাভপুর আসনেই তৃণমূল প্রার্থী অসিত মাল ৪৮ হাজার ৩৮৩ ভোটে জয়ী হয়েছেন। যা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পাওয়া ‘লিডের’ দ্বিগুণেরও বেশি।
এই বিপুল জয়ের পরেও অবশ্য দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত অধরা রয়ে গিয়েছে শাসকদলের। লাভপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে সাঁইথিয়া ব্লকের ৬টি এবং লাভপুর ব্লকের ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই পঞ্চায়েতগুলির মধ্যে লাভপুর ব্লকের ইন্দাসে প্রায় ২৩৬০, জামনায় প্রায় ৪৪২, চৌহাট্টা মহোদরী- ২ পঞ্চায়েতে প্রায় ৪০০ ভোটে এবং সাঁইথিয়া ব্লকের শ্রীনিধিপুরে প্রায় ৪৩০ ভোটে পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অবশ্য বিরোধীরা অধিকাংশ আসনে প্রার্থী দিতে না-পারায় এই পঞ্চায়েতগুলিতে তৃণমূল এক তরফা জয় পায়।
সেই নিরিখে এ বারের নির্বাচনে গত লোকসভা ভোটে পিছিয়ে থাকা পঞ্চায়েতগুলিতেও জয়ী হওয়ার লক্ষ্য নিয়েছিল শাসকদল। তা সত্ত্বেও ইন্দাস এবং শ্রীনিধিপুরে পিছিয়ে রয়েছে তারা। যদিও ইন্দাসে ব্যবধান কমে হয়েছে ১৪৭৩ এবং শ্রীনিধিপুরে মাত্র ৫। এই নিয়ে আফশোস রয়েছে স্থানীয় নেতৃত্বের।
নির্বাচনের আগে আমোদপুরে মেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তার পরেও এমন ফলাফল বিজেপিকে নিরাশ করেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফলের নিরিখে লাভপুরে প্রাপ্ত ভোট গত বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় এক থাকলেও এ বারে ওই কেন্দ্রে অনেকখানি পিছিয়ে পড়েছে গেরুয়া শিবির। অথচ লাভপুরে বিজেপির ভাল সংগঠন আছে। এক সময় দাঁড়কা, লাভপুর ১, লাভপুর ২ প্রভৃতি পঞ্চায়েতে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাও পালন করেছে তারা।
কেন বিপর্যয়, তা নিয়ে পর্যালোচনায় বিজেপি-র অন্দরে যে তথ্যটি উঠে এসেছে, সেটি হল, দলের কর্মীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, সন্ন্যাসীচরণ মণ্ডল সাংগঠনিক জেলা (বোলপুর) সভাপতি হওয়ার পরে দলের দুঃসময়ের ও পুরনো কর্মী, প্রাক্তন জেলা সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মণ্ডল, প্রাক্তন মণ্ডল সভাপতি সুবীর মণ্ডল, লাভপুর বিধানসভার আহ্বায়ক ভগীরথ মণ্ডল, জেলা যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক অনির্বাণ মণ্ডলদের মতো একাধিক নেতা কার্যত গুরুত্বহীন হয়ে পড়েন। এ বারের নির্বাচনী ময়দানে তাঁদের দেখা যায়নি বললেই চলে। পুরনো নেতা-কর্মীরা বসে যাওয়ার প্রভাব লাভপুরে বিধানসভা আসনে পড়েছে বলেই বিজেপির নিচুতলার কর্মীদের মত।
বিশ্বজিতের অভিযোগ, ‘‘আমাদের দলের প্রার্থী পিয়া সাহা বাড়িতে এসে দেখা করে গেলেও দলের তরফ থেকে আমাদের ভোটে নামার কথা বলা হয়নি। তাই ভোটের ময়দানে আমাদের দেখা যায়নি।’’ সন্ন্যাসীচরণের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ব্যক্তিগত ভাবে বলা না হলেও দলগত ভাবে সবাইকে ভোটের কাজে ঝাপিয়ে পড়তে বলা হয়েছিল। দলের এক জন প্রকৃত কর্মী কখনও বলার অপেক্ষা রাখে না।’’ তাঁর দাবি, লাভপুরে মানুষ নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি বলেই বিজেপি লিড ধরে রাখতে পারেনি।
রাজনৈতিক মহলের অবশ্য সেটাই একমাত্র কারণ নয় বলে অভিমত। তাদের মতে, এলাকার উন্নয়ন, সাংগঠনিক সমন্বয় এবং জনসংযোগই তৃণমূলকে এগিয়ে দিয়েছে। বাম আমলে শুরু হওয়া লাঘাটা এবং গুনুটিয়া সেতু নির্মাণকাজ শেষ হওয়া, ফুল্লরাতলার সৌন্দর্যায়ন-সহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রচারের হাতিয়ার করেছিল তৃণমূল। ভোটের আগে প্রতিদিন বুথভিত্তিক একাধিক সভা করা হয়েছে। দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের চোরাস্রোত বইলেও তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি। সর্বোপরি রয়েছে লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ ওরফে রানা সিংহের নিবিড় জনসংযোগ। বিপদআপদের পাশাপাশি ফুটবল খেলা, রক্তদান শিবির থেকে শুরু করে শ্রাদ্ধবাসর এমনকি হরিনামের আসরেও উপস্থিত থেকেছেন বিধায়ক। সেই সুবাদে প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জেও তিনি পরিচিত মুখ।
বিজেপির এক স্থানীয় নেতার কথায়, ‘‘একে জনসংযোগে আমরা কয়েক যোজন পিছিয়ে ছিলাম, তার উপরে, তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি-সহ নেতিবাচক দিকগুলি জনসমক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে তুলে ধরা যায়নি। পুরনো নেতারা বসে গিয়েছেন। তার ফল যা হওয়ার হয়েছে।’’ তাঁর দাবি, বিভিন্ন সময় শাসকদলের নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে নামে-বেনামে জমি হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। কাটমানি, বালিপাচারেও নাম জড়িয়েছে। তাঁরা সেগুলিকে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেননি ঠিকঠাক। অভিজিৎ সিংহ অবশ্য ওই সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘‘বহুমুখী উন্নয়নের জন্যই জনগণ আমাদের সমর্থন করেছেন। সেই জন্যই আগের নির্বাচনগুলি থেকে আমরা এগিয়ে চলেছি। পরবর্তীতে যেখানে পিছিয়ে আছি, সেখানেও এগিয়ে যাব।’’