প্রতীকী ছবি।
নয় বছর আগে পুরুলিয়া বিধানসভায় সিপিএমের গড়ে মাথা তুলেছিল তৃণমূল। তারপর উত্থানপতনের সাক্ষী এই কেন্দ্র। একদা রাঢ়বঙ্গের এই অঞ্চলে যাদের অনুমতি ছাড়া গাছের পাতাও নড়ত না বলে কথিত রয়েছে, সেই সিপিএম এখন এখানে কার্যত প্রান্তিক শক্তিতে পর্যবসিত। নজিরবিহীন ভাবে পলাশের এই দেশে মাথা তুলেছে গেরুয়া ঝাণ্ডা। কংগ্রেসের সংগঠন থাকলেও সময়ের প্রবাহে তাতে ধস নেমেছে। তাই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, লোকসভা ভোটে এই অঞ্চলে মূল লড়াই ঘাস ফুলের সঙ্গে পদ্মের।
২০১১ সালে পুরুলিয়া বিধানসভা আসনটি (যার অধীনে রয়েছে পুরুলিয়া পুরসভার ২৩টি ওয়ার্ড, এবং পুরুলিয়া ১ ও পুরুলিয়া ২ ব্লকের মোট ১১টি পঞ্চায়েত) বামেদের থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটেও তৃণমূলের জয়যাত্রা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালে বদলে যায় শাসকদলের অভ্যন্তরীন সমীকরণ। দলের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সেবার বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দলছুট তৃণমূল নেতা সুদীপ মুখোপাধ্যায়। তাঁর কাছে পর্যুদস্ত হন তৃণমূল প্রার্থী। প্রত্যাবর্তন হয় বাম-কংগ্রেসের।
গত বছর পঞ্চায়েত ভোটের পর ফের ওলটপালট হয় রাজনৈতিক চিত্র। একদিকে যেমন তৃণমূল এই বিধানসভার গ্রামাঞ্চলে আধিপত্য বজায় রাখে, অন্যদিকে বাম-কংগ্রেসকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে বিরোধী পরিসরের দখল নেয় বিজেপি। বহু জায়গায় ‘অপ্রত্যাশিত’ ভাল ফল করে বিজেপি।
পুরুলিয়া আসনের তৃণমূল প্রার্থী মৃগাঙ্ক মাহাতোর বিশ্বাস, পঞ্চায়েত ভোটের প্রভাব লোকসভা নির্বাচনে পড়বে না। তাঁর কথায়, ‘‘লোকসভা ভোট আর পঞ্চায়েত ভোট এক নয়। আমি পঞ্চায়েত এলাকাতেও কাজ করেছি। যে কারণে পঞ্চায়েতে কিছু জায়গায় আমাদের ফল খারাপ হয়েছিল, সেই কারণগুলি লোকসভা ভোটে প্রযোজ্য নয়।’’
জেলা রাজনীতির ওঠাপড়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের একাংশ মনে করছেন, গত এক বছরে পুরুলিয়া বিধানসভা এলাকায় প্রভাব বেড়েছে বিজেপির। পঞ্চায়েত ভোটের পর বাম এবং কংগ্রেসের সংগঠনের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাতে থাবা বসিয়েছে তৃণমূল ও বিজেপি। কংগ্রেস নেতৃত্বের একাংশ যেমন
তৃণমূলে ভিড়েছেন, বাম কর্মী-সমর্থকদের বড় অংশ যোগ দিয়েছেন গেরুয়া শিবিরে। তাই পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে লড়াই ‘চতুর্মুখী’ হলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে পুরুলিয়া বিধানসভা এলাকায় লড়াইটা কার্যত তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির।
সিপিএম জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায়ের বক্তব্য, ‘‘এক সময় পুরুলিয়ায় আমাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। অতীতে একাধিকবার জিতেছি। তৃণমূল এবং বিজেপির আসল চরিত্র মানুষ দেখছে। সেই কথাগুলি মানুষকে বলছি। আশা করছি আমরা মানুষের সমর্থন ফিরে পাব।’’ এই কেন্দ্রে বাম প্রার্থী বীরসিংহ মাহাতো।
তৃণমূলকর্মীদের একাংশ জানাচ্ছেন, কিছুটা হলেও চিন্তার কারণ বিজেপির সাম্প্রতিক মিছিলগুলিতে তরুণদের ‘ঢল’। রামনবমী উপলক্ষে গেরুয়া মিছিলে হেঁটেছেন বহু তরুণ। পুরুলিয়া লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতোর প্রচার, সভা এবং মনোনয়ন জমা দেওয়ার মিছিলে তরুণদের চোখে পড়েছে। জেলার সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে গেরুয়া শিবির তরুণ প্রজন্মকে ভুল বোঝাচ্ছে।’’
শোভাযাত্রা বার করে শাসকদলও। বিজেপির প্রভাব যে বেড়েছে তা অকপটে স্বীকার করেছেন কংগ্রেস বিধায়ক সুদীপ। তাঁর কথায়, ‘‘কোন জায়গাই শূন্য থাকতে পারে না। গণতন্ত্রে বিরোধী থাকবেই। যেদিন থেকে শাসকদল রাজনীতির ময়দান বিরোধী শূন্য করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকেই গেরুয়া রাজনীতির ভিত শক্ত হয়েছে।’’
তরুণদের সঙ্গে পেতে চেষ্টার কসুর করছেন না পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো। তিনি বলেন, ‘‘চাকরির সুযোগ থেকে তরুণ প্রজন্ম বঞ্চিত। চাকরির ক্ষেত্রে স্থানীয়দের অগ্রাধিকার আমার লক্ষ্য।’’
আলোচনা চলছে আরও বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়েও। বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, শহরের দীর্ঘদিনের পানীয় জলের সমস্যার সমাধান হলেও আবর্জনা সাফাইয়ে পুরসভা সফল নয়। ফুটপাত দখল, বস্তি এলাকায় সে ভাবে উন্নয়ন না হওয়া, পঞ্চায়েত এলাকায় শাসকদলের একাংশের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন, মানুষের সঙ্গে দূরত্ব, কর্মসংস্থান নিয়ে অসন্তোষের মতো বিষয়গুলিও ঘুরে ফিরে আসছে আড্ডায়, আলোচনায়।