আধার কার্ড করাতে রাত থেকেই লাইন

বুধবার জেলা মুখ্য ডাকঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল, শতাধিক মানুষের জটলা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ ০৩:০০
Share:

প্রতীক্ষা: বাঁকুড়া মুখ্য ডাকঘরের সামনে দীর্ঘ লাইন। —নিজস্ব চিত্র

কেউ ভ্রম সংশোধন করাবেন, কেউ আবার নতুন আধার কার্ড বানাবেন। আর এর জন্য কেউ বাসে চড়ে, কেউ আবার মোটরবাইক নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকা থেকে ছুটে আসছেন জেলা সদর বাঁকুড়ায়। ভোরের আলো ফোটার আগেই জেলা মুখ্য ডাকঘরের সামনে এসে জড়ো হচ্ছেন তাঁরা। আবার অনেকেই রাত কাটাচ্ছেন ডাকঘরের সামনের ফুটপাতে! কোলে বাচ্চা নিয়েই কেবল আধার কার্ডের জন্য এই কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন গৃহবধূ থেকে অশীতিপর বয়স্কেরা।

Advertisement

বুধবার জেলা মুখ্য ডাকঘরের সামনে গিয়ে দেখা গেল, শতাধিক মানুষের জটলা। কেউ বাঁকুড়া শহর বা শহর সংলগ্ন গ্রামের। আবার অনেকেই এসেছেন সারেঙ্গা, রাইপুর, শালতোড়ার মতো দূর-দূরান্তের ব্লক থেকে। অনেকেই জানাচ্ছেন, কাজ না হলে প্রয়োজনে রাত কাটাবেন রাস্তার পাশেই। সে জন্য লোটা-কম্বলও এনেছেন সঙ্গে করে। প্রতিদিন ৮০ জনের আধারে নাম তোলা বা সংশোধন করা হলেও সেই ‘অ্যাপয়েন্টমেন্ট’-এর ‘টোকেন’ তোলার লাইনে দাঁড়াচ্ছেন অন্তত দেড়শো জন। লাইনে দাঁড়িয়ে ‘টোকেন’ পেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগছে।

আধারকার্ড তৈরি ও সংশোধনের এই কাজ নিয়মিত চলবে। তা হলে এত হুড়োহুড়ি কেন? প্রশ্ন শুনেই জেলা মুখ্য ডাকঘরের সামনে লাইনে দাঁড়ানো ওন্দার পুনিশোলের বাসিন্দা মহম্মদ ফারুখ মণ্ডল, সিদ্দিউল মণ্ডল দাবি করলেন, “আধার কার্ড তৈরি হয়তো জীবনভর চলবে। কিন্তু এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জি) যে কোনও দিন চালু হয়ে যেতে পারে। তখন তো বিপাকে পড়তে হবে।’’

Advertisement

সুলুক-সন্ধান

জেলায় শুরু

• ২০১৮-র শেষ থেকে বাঁকুড়া জেলা মুখ্য ডাকঘরে আধার কার্ড তৈরির কাজ শুরু হয়। ভিড় বাড়ে লোকসভা ভোটের পর থেকে।

কাজ চলছে

• তালড্যাংরার সাবড়াকোন, রানিবাঁধ, জয়পুর, বিষ্ণুপুরের রসিকগঞ্জ, বাঁকুড়া শহরের কেন্দুয়াডিহি, কেশিয়াকোল, ওন্দা, পাত্রসায়র, বেলিয়াতোড়, গঙ্গাজলঘাটি, মেজিয়া, গড়রাইপুর, সারেঙ্গা ও ইন্দাস উপ-ডাকঘর, বিষ্ণুপুর ও সোনামুখী মুখ্য-ডাকঘরে।

পরিসংখ্যান

• জেলার বিভিন্ন উপ-ডাকঘরে দৈনিক গড়ে ২০টি করে নতুন আধারকার্ড করা বা সংশোধন করা হচ্ছে। জেলা ডাকঘরে দৈনিক গড়ে ৮০টি করে।

টোকেন

• যার নাম তোলা হবে বা যার নাম সংশোধন করানো হবে তাঁকে নির্দিষ্ট দিন ও নির্দিষ্ট সময় বলে চিরকুট দেওয়া হচ্ছে। কার্ড তৈরি বা সংশোধন করতে এক মাস পরে সময় দেওয়া হচ্ছে।

একই আশঙ্কা নিয়ে আধার কার্ড তৈরির লাইনে দাঁড়িয়েছেন সিমলাপাল থেকে আসা প্রৌঢ়া মিঠু ঘোষ, তালড্যাংরা থেকে আসা শঙ্কর নন্দী, শালতোড়ার কাজলি টুডুরাও। সকলেই ভোরের আলো ফোটার আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘‘ঠিকমতো তথ্য না দিতে পারলে নাকি দেশে থাকতে দেওয়া হবে না বলে শুনছি। যদি কাজে লাগে তাই সব কাজ ফেলে আধার কার্ড করাতে এসেছি।’’

কাজলিদেবী বলেন, “আমাদের গ্রামের অনেকেই এসে এক দিনে কাজ শেষ করতে না পেরে রাস্তার পাশে রাত কাটিয়েছেন। তাদের পরামর্শে আমরাও রাত কাটানোর প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। এতটা পথ উজিয়ে রোজ রোজ আসা সম্ভব নয়।” পুনিশোলের বাসিন্দা মঙ্গুল আলি আনসারিও বলেন, “এনআরসি হলে বিপদে পড়ার চেয়ে রাত জেগে আধার কার্ড বানিয়ে রাখাই ভাল।” জেলা প্রশাসনের কর্তারা অবশ্য সাফ জানাচ্ছেন, আধার কার্ডের সঙ্গে এনআরসি-র কোনও সম্পর্কই নেই।

এ দিকে ডাকঘরে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মানুষজনের সকলেরই দাবি, এই কাজ যদি নিজ নিজ এলাকা বা অন্তত ব্লকে হত, তা হলে তাঁদের ভোগান্তি কমত। যদিও ডাকঘরের আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, ইতিমধ্যেই জেলার বহু উপ-ডাকঘরে আধারকার্ড তৈরি ও সংশোধনের কাজ চলছে। এ ছাড়া, জেলার কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও বেসরকারি ব্যাঙ্কেও এই কাজ হচ্ছে।

তার পরেও কেন জেলা মুখ্য ডাকঘরেই ভিড়?

জেলা ডাকঘরের কর্তাদের বড় অংশই মানছেন, উপ-ডাকঘরগুলিতে পরিষেবার মান ভাল নয়। এর অন্যতম কারণ কর্মী-সঙ্কট। তা ছাড়া আধার কার্ড যিনি তৈরি করবেন, তাঁকে ইউআইডিএআই-এর (ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া) একটি বিশেষ পরীক্ষা ও নানা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাড়পত্র নিতে হবে। ডাকঘর ও ব্যাঙ্কের গুটিকয় কর্মী ওই ভাবে ছাড়পত্র নিয়ে কাজ করছেন।

জেলা মুখ্য ডাকঘর সূত্রে জানা যাচ্ছে, বাঁকুড়া জেলা ডাকঘরে মোট ১২ জন কর্মী আধার কার্ড তৈরির জন্য ছাড়পত্র পেয়েছেন। উপ-ডাকঘরগুলিতে কোথাও এক বা দু’জন করে কর্মী রয়েছেন। আধার কার্ড তৈরির জন্য আলাদা ভাবে কর্মী নিয়োগও করা হয়নি। ডাকঘরের কাজ সামলে আধার কার্ড তৈরি করতে গিয়ে কর্মীরা হিমসিম খাচ্ছেন। তার উপরে আবার প্রায়দিনই ইন্টারনেটের সংযোগ ব্যাহত হচ্ছে।

জেলা ডাকবিভাগের সিনিয়র সুপারিন্টেডেন্ট রামেশ্বর দয়াল বলেন, “উপ-ডাকঘরগুলিতে কাজ হচ্ছে ঢিমেতালে। সমস্যা মেটাতে আমরা নতুন করে ১২ জন গ্রামীণ ডাক সেবককে আধার কার্ড তৈরি ও সংশোধনের কাজ শেখানোর চেষ্টা করছি। তাঁরা ছাড়পত্র পেলেই বিভিন্ন উপডাকঘরগুলিতে নিয়োগ করব।”

পাশাপাশি, তাঁর অভিমত, “জেলার যে ব্যাঙ্কগুলিতেও আধারের কাজ হচ্ছে তারা আরও একটু সক্রিয় হলে সাধারণ মানুষের হয়রানি অনেকটাই কমবে।” জেলার একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্তা বলেন, “ব্যাঙ্কগুলি এমনিতেই কর্মী সঙ্কটে ভুগছে। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ আধারকার্ডের কাজ নিয়ে এলে আমরা করে দিচ্ছি।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement