মৃতপ্রায় দ্বারকা। তারাপীঠ সেতু থেকে।
আড়েবহরে যত বেড়েছে, পরিকাঠামোর হাল তত নিম্নমুখী হয়েছে। এমনটাই অভিযোগ ছিল রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটনকেন্দ্র তারাপীঠকে ঘিরে। কিন্তু, দেড় বছর আগে জাতীয় পরিবেশ আদালতের গুঁতোয় কিছুটা হলেও নড়েচড়ে বসে রাজ্য সরকার। নয়া পর্ষদ গড়া হয়েছে। বরাদ্দ হয়েছে কোটি কোটি টাকাও। তার পরেও তারাপীঠের ছবিটা পাল্টেছে? কতটাই বা কমেছে দ্বারকা নদ এবং সংলগ্ন এলাকার দূষণ? প্রশাসন ও শাসকদলের নেতাদের মুখে ‘পরিবর্তনে’র দাবি শোনা গেলেও বাস্তবের ছবিটা কিন্তু ততটা আশানুরূপ নয়। বেশ কিছু কাজ হয়েছে। কিছু কাজ শুরুও হয়েছে। আবার বহু ক্ষেত্রে আজও বেশ পিছিয়ে রয়েছে এই বিশেষ তীর্থ ক্ষেত্রটি। সম্পূর্ণ দূষণমুক্ত পর্যটনকেন্দ্রের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে এখনও অনেকটাই পথ হাঁটা বাকি তারাপীঠের।
ঘটনা হল, তারাপীঠের হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে যথেচ্ছ দূষণ ছড়ানোর অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। তার জেরে বিপন্ন হয়ে পড়ে কার্যত নালার আকার নিয়েছে দ্বারকা নদ। পরিবেশের হাল ফেরাতে দেড় বছর আগে জাতীয় পরিবেশ আদালতের পূর্বাঞ্চল বেঞ্চে ব্যবসায়ীদের এবং প্রশাসনের গাফিলতির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। তার জেরেই সরকার এবং পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে তারাপীঠের বেআইনি হোটেল-রেস্তোরাঁগুলির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার পাশাপাশি দ্বারকার দূষণ রুখতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল আদালত। নির্দেশ পেয়ে তারাপীঠে দ্বারকা নদের সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে সেচ দফতর। মন্দির লাগোয়া দোকান সরানো হয়েছে। পুরোপুরি রোখা না গেলেও প্লাস্টিক ব্যবহারে সামান্য রাশ টানতে পেরেছে প্রশাসন। দ্বারকা সেতু থেকে মন্দির যাওয়ার রাস্তা দখলমুক্ত করা হয়েছে। তারাপীঠ পঞ্চমুণ্ডির বশিষ্ট মুনির আশ্রম থেকে দখলদার সরিয়ে শুরু হয়েছে অডিটোরিয়ামের কাজ।
এই একগুচ্ছ অগ্রগতির পরেও এর ঠিক উল্টো ছবিও আছে। যাঁর মামলার জেরে আদালতের ওই সব নির্দেশ, সেই জয়দীপ মুখোপাধ্যায়েরই বক্তব্য, কিছু কাজ হয়েছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু, প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও এখনও বহু পদক্ষেপ করার ক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে আছে প্রশাসন। তাঁর অভিযোগ, পরিবেশ আদালতের নির্দেশের পরেও তারাপীঠে এখনও হোটেল, রেস্তোরাঁগুলিতে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ বসানোর কাজ শুরু হয়নি। ফলে আগের মতোই তারাপীঠের হোটেল-রেস্তোরাঁ থেকে নির্গত বর্জ্য দ্বারকায় গিয়ে মিশছে। এ ছাড়াও শ্মশানে এখনও বৈদ্যুতিক চুল্লি নির্মাণ হয়নি, শ্মশান এলাকায় আলাদা করে পাঁচিল নির্মাণও হয়নি। সব থেকে বড় কথা তারাপীঠ এলাকায় এখনও জঞ্জাল ফেলার কোনও সুষ্ঠু ব্যবস্থা প্রশাসন গড়ে তুলতে পারেনি। এমনকী, গড়া হয়নি মন্দির চত্বরে দেশ-বিদেশ থেকে আসা দর্শনার্থীদের পুজো দেওয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থাও। আজও রয়ে গিয়েছে ৫০০-১০০০ টাকার বিনিময়ে মা তারা দর্শনের মতো অনৈতিক ব্যবস্থাও, অভিযোগ হুগলি সুব্রত সাধু খাঁ, মজফ্ফরপুরের রবি রঞ্জনদেরও।
এই সব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে তারাপীঠ ঘুরেও। শুক্রবার শ্মশান লাগোয়া একটি লজের সামনে গিয়ে দেখা গেল নিকাশি নালা দিয়ে সব সময়ই দূষিত জল দ্বারকায় গিয়ে পড়ছে। তার জেরে দ্বারকার প্রায় কুড়ি বর্গমিটার এলাকার জল পচা দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে। শ্মশান এলাকা ছাড়িয়ে দ্বারকা সেতু লাগোয়া তারা মা তলা ঘাটের কাছে নদীর পূর্ব পাড়ে বেশ কয়েকটি লজ থেকে দূষিত জল নদীতে পড়ছে। একই ছবি দ্বারকা নদের অপর পাড়ে কবিচন্দ্রপুর মৌজার, মুন্ডমালিনী তলা যাওয়ার রাস্তার একপাশে নদীর পাড়ে থাকা লজগুলিতেও। তারা মা তলা ঘাটে নদী বক্ষেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাগজের গ্লাস, থার্মোকলের পাতা, প্লাস্টিকের বাটি পড়ে। ওই ঘাট, শ্মশান লাগোয়া স্নান করার ঘাটগুলি নোংরা আবর্জনা, মলমূত্রে ভর্তি। দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে থাকাই মুশকিল। নদী পাড় ধরে হাঁটতে গেলে নোংরায় পা পড়াটাও অবধারিত।
আবার তারাপীঠ ঢোকার মুখেই চিলা কাঁদর সংলগ্ন এলাকায় দেখা গেল রাস্তার ধারেই জঞ্জাল ফেলছে ‘তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ’-এর গাড়ি। জৈব আবর্জনা থেকে প্লাস্টিক— অবৈজ্ঞানিক ভাবে সব কিছু মিশে থাকা সেই জঞ্জালই আবার পোড়ানো হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়েছে। পাশাপাশি ঝলসে গিয়েছে রাস্তার ধারে থাকা গাছ। চিলা কাঁদরের মাঠে আবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেল পিকনিক পার্টির ফেলে যাওয়া এঁটো থার্মোকল পাতাও। ‘অপরিবর্তন’-এর একই ছবি মন্দির চত্বরেও। দর্শনার্থীদের হাতে নিষিদ্ধ প্লাস্টিকেই পুজোর প্রসাদ নিয়ে ঘুরতে দেখা গেল এ দিনও।
মা তারা ঘাটে আবর্জনায় ভরেছে দ্বারকার জল।
প্রশাসন অবশ্য বরাদ্দের খতিয়ান দিয়েই ওই সব অভিযোগের খণ্ডন করছে। তারা তুলে ধরছে এলাকার সৌন্দর্যায়নের নানা তথ্য। ‘তারাপীঠ-রামপুরহাট উন্নয়ন পর্ষদ’ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে ৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রামপুরহাটের মনসুবা মোড় থেকে তারাপীঠ তিনমাথা মোড় পর্যন্ত রামপুরহাট-সাঁইথিয়া সড়ক সংস্কারের কাজ শুরু হয়েছে। সংস্কার হবে রাস্তার উপরে থাকা সেতুগুলিরও। তারাপীঠের সৌন্দর্যায়নের জন্য নিকাশি নালা সংস্কার, রাস্তার দু’ধারে ‘লকিং ব্রিক্স’ বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া তিনটে সুদৃশ্য তোরণ নির্মাণের কাজও শুরু হয়েছে। ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে রাজ্য পর্যটন দফতরও। প্রথম পর্যায়ে মেলা দু’কোটি টাকায় দ্বারকা সেতু থেকে ফুলিডাঙা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যানজট এড়াতে রাস্তার দু’ধারে গার্ডওয়াল তৈরি করা হবে। বাকি ১০ কোটি টাকায় ওই বাসস্ট্যান্ডের সংস্কার, রাস্তার দু’ধারে আলোর ব্যবস্থা-সহ নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে।
এ দিকে, তারাপীঠকে ঘিরে বেসরকারি হোটেলগুলি রমরমিয়ে ব্যবসা চালালেও পর্যটকদের থাকার জন্য গোটা এলাকায় সরকারি ব্যবস্থাও নেই। একমাত্র সম্বল বেনফিসের একটি তিনতলা বাড়ি। পাশাপাশি মা তারার মন্দির ছাড়াও এখানে তেমন কোনও দর্শনীয় কিছু নেই। ফলে এক, দু’দিন থেকেই পর্যটকেরা ফিরে যান। সে ক্ষেত্রে এলাকায় ইকো-পার্ক, জু-পার্ক বা, বোটিংয়ের মতো বিনোদনের মতো ব্যবস্থা গড়া হলে পর্যটনের দিক থেকে তারাপীঠের গুরুত্ব আরও বাড়বে। এ ব্যাপারে সরকারি দিক থেকে পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। সে কথা মানছেন ‘তারাপীঠ লজ ব্যবসায়ী সমিতি’র সম্পাদক দেবীপ্রসাদ মণ্ডল, হোটেল ম্যানেজার সুনীল গিরিরাও। পরিস্থিতির মোকাবিলায় আপাতত আটলা মোড়ে পর্ষদের অফিসেই পর্যটকদের থাকার পরিকল্পনা করছে পর্ষদ। বিভিন্ন সরকারি দফতর তারাপীঠেই হেস্ট হাউস নির্মাণে আগ্রহী বলেও সংস্থার দাবি।
মন্দিরের প্রবেশ মূল্য নিয়ে ওঠা অভিযোগ মানতে চাননি মন্দিরের সেবাইত এবং পর্ষদের ভাইস চেয়ারম্যান সুকুমার মুখোপাধ্যায়। অন্য দিকে, দ্বারকা দূষণের প্রেক্ষিতে দেবীপ্রসাদবাবুর বক্তব্য, লজগুলিতে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট’ ব্যবস্থা চালু করার জন্য রাজ্যের জন স্বাস্থ্য কারিগরী দফতর ছ’মাস সময় নিয়েছে। শীঘ্রই ছবিটা পাল্টে যাবে। এই পরিস্থিতিতে তা হলে হোটেল-রেস্তোরাঁগুলি চলছে কি করে? জবাব মেলেনি দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের কাছে। ফোন ধরেননি পর্ষদের চেয়্যারম্যান তথা প্রতিমন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়। সাড়া মেলেনি জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীরও।
তবে, আজ এলাকায় গিয়ে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন পর্ষদের সিইও তথা বীরভূমের অতিরিক্ত জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস।
ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।