এই পুঁথিই সংরক্ষণ করা হচ্ছে। ফাইল চিত্র
ল্যামিনেশন করা সম্ভব হল শতাব্দী প্রাচীন দুর্গাপুজোর পূজাবিধি লেখা ভুর্জপত্রের পুঁথির। স্বস্তি ফিরেছে রাজনগরের বেলাড়া গ্রামের এই ঐতিহ্যশালী দুর্গাপুজোর দায়িত্বে থাকা শরিকদের। দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়েছেন পুজোর দায়িত্বে থাকা আশি ছুঁই ছুঁই পুরোহিতও।
পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো এই পুজোর পদ্ধতি ও মন্ত্র। যা লিখিত ছিল প্রথমে তাল পাতায়, পরে সেখান থেকে নকল করে ভুর্জপত্রে তোলা হয়। কিন্তু কালের নিয়মে তা ক্রমশ জীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ পুঁথি নষ্ট হয়ে গেলে পুজো কী ভাবে, সেটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেক ভেবে ও ঝুঁকি নিয়ে সেগুলিকে জেলা সদর সিউড়ি থেকে ল্যামিনেশন করানো গিয়েছে। তা সংরক্ষণের পরে এখন চাপ মুক্ত মনে হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের।
পরিবারের সদস্যেরা জানান, প্রাচীন ওই পুজোর পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস। পারিবারিক ইতিহাস বলছে, ভবানীপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদাইপুর গ্রামেই বাংলা ১০০১ সালে এই পুজোর সূচনা হয়। সূচনা করেছিলেন পূর্বপুরুষ গোপালচন্দ্রদেব শর্মণ। পরে শ্রীধর ও কৃতীদেব শর্মণদের চেষ্টায় জঙ্গল ঘেরা বেলেড়ায় পুজো উঠে আসে বাংলার ১০১০ সালে। বর্তমানে চারশো বছরেরও বেশি প্রাচীন এই পুজোর সেবাইত শিকদারদের দু’টি পরিবার এবং দৌহিত্র চক্রবর্তী ও বন্দ্যোপাধ্যায়দের দু’টি— সব মালিয়ে মোট চারটি পরিবার। তবে উল্লখেযোগ্য এর পুজোর প্রাচীন পদ্ধতি এবং পুঁথির ইতিহাস।
শরিক বেচুরাম শিকদার, বীরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, আর এক সেবাইত শ্রদ্ধানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়রা শোনাচ্ছিলেন সেই গল্প। তাঁরা জানান, মোট তিনটি পুঁথি রয়েছে— দু’টি দুর্গাপুজোর, অন্যটি জন্মাষ্টমীর পুজো নিয়ে। পুঁথি দু’টির সংস্কৃত মধ্যযুগীয় বাংলা লিপিতে লেখা। পুঁথি থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বাংলার ১০১০ সালে দুর্গাপুজো সংক্রান্ত দু’টি পুঁথি লিখেছিলেন বলরাম বাচস্পতি নামে তৎকালীন এক সংস্কৃত পণ্ডিত। তালপাতার পুঁথিগুলি প্রায় ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে উঠলে, বাংলার ১৩১৬ সালে তালপাতার পুঁথিটি নকল করে লেখা হয় ভুর্জপত্রে। শতাব্দী পেরিয়ে সেগুলিও প্রায় নষ্ট হতে বসেছিল।
বর্ষীয়ান পুরোহিত প্রফুল্ল ঘোষাল বলেন, ‘‘ষষ্ঠীর দিন লাল শালুর বাঁধন খুলে সযত্নে বের করে আনতাম তাল ও ভুর্জপত্রে লেখা পুথিগুলি। এত বছরের অভ্যাস। পুঁথির উপরে হাত রাখলেই সব মনে পড়ে যেত। কিন্তু আমার চিন্তা ছিল ভবিষ্যৎ নিয়ে। এখন আর সেই ভয় নেই।’’
আদতে পারিবারিক হলেও বেলেড়া গ্রামের এই দুর্গাপুজোর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জুড়ে গিয়েছে গোটা গ্রাম। শুধু গ্রামবাসী নন, গোটা পঞ্চায়েত এলাকা, ব্লক ও ব্লকের বাইরে ছড়িয়ে রয়েছে বেলেড়া মায়ের কথা। সপ্তমীর সকাল থেকে দুর্গা মণ্ডপে তিলধারণের জায়গা থাকে না। পুজোর সময় বাড়িতে আত্মীয়েরা আসেন। অনেকে গাড়িতে দূর থেকে পুজো দেখতে আসেন। পুজোর বিপুল খরচ, মন্দির নির্মাণ থেকে ভোগ রান্না, আলো দিয়ে সাজানো থেকে সিসি ক্যামেরা বসানো— সমস্ত আয়োজনই হয় ভক্তদের দানে। শরিকেরা জানান, পরিশ্রম ছাড়া পুজোর সময় আর কিছু নিয়ে ভাবতে হয় না। পুঁথি নিয়ে যে ভাবনা ছিল, তাও আর নেই।
যদিও ল্যামিনেশন করে পুঁথি সংরক্ষণের বিষয়ে সন্দিহান সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ও পুঁথি গবেষক নবগোপাল রায়। তিনি বলেন, ‘‘পুঁথি সংরক্ষণের নানা আধুনিক পদ্ধতি আছে। সেই সব পদ্ধতি ব্যবহার করলে পুঁথির আয়ু বাড়বে।’’