সাবেক: লাভপুরের তারামাডাঙার পুজো। বুধবার। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি
আজও কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে আলাদা ভাবে মনে পড়ায় তারামায়ের পুজো। কারণ, ওই পুজোকে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত।
প্রচলিত রয়েছে, ১৮৯৭ সালে স্থানীয় বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া একটি ডাঙায় ওই পুজোর প্রচলন করেন এলাকার জমিদার হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। একসময় তিনি ছিলেন অপুত্রক। রামোজি গোঁসাই নামে এক তান্ত্রিকের পরামর্শেই তিনি তন্ত্র মতে তারামায়ের পুজো সহ পুত্রেষ্টি যজ্ঞও করেন। ওই যজ্ঞের বছরখানেকের মধ্যেই নাকি হরিদাসবাবু পুত্রসন্তান লাভ করেন। তারামায়ের নামানুসারেই সেই ছেলের নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর। পরে যাঁর সাহিত্যিক হিসেবে প্রসিদ্ধি। আর ওই ডাঙাটি তারামা ডাঙ্গা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে। সেই সময় পুজো চালাতে বরাদ্দ হয় দেবোত্তর জমিও।
কিন্তু, জমিদারি প্রথা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে সেই সব জমির বড় অংশই বেহাত হয়ে যায়। নানা প্রতিকূলতায় পুজো এক সময় উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় নামো সদর হিসাবে খ্যাত সাহিত্যিকের পারিবারিক দুর্গামণ্ডপে। অব্যবহারে ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়ে তারামাডাঙায় জমিদারি আমলে তৈরি মন্দির। এমনিতেই জমিদার বাড়ির পারিবারিক গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ ওই পুজোয় প্রথম থেকেই সেই অর্থে অন্যদের সার্বিক যোগদানের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। তার উপরে তারামাডাঙা থেকে নামো সদরে স্থানান্তরিত হওয়ায় সেই গণ্ডীটা আরও ছোট হয়ে পড়ে।
নিতান্তই পারিবারিক সেই পুজোয় এখন সর্বজনীনতার ছোঁয়া লেগেছে। বেড়াটা ভাঙতে শুরু করে বছর পাঁচেক আগে। সাহিত্যিকের ভ্রাতুপুত্র তথা চিত্র পরিচালক পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ট্রাস্টি বোর্ড গড়ে তারামাডাঙায় মন্দির পুননির্মাণ করে ফের সেখানে পুজো স্থানান্তরিত করেন। তারপর থেকেই সর্বজনীনতার ছোঁয়া লেগেছে পুজোয়। চর্তুদশীর রাতে তারামায়ের পুজোয় মেতে ওঠেন লাভপুরের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষজন।
স্থানীয় গৃহবধূ স্বপ্না বন্দ্যোপাধায়, মাধবী বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণা রায়, রীতা পাল, শ্যামা চক্রবর্তীরা জানান, সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মতোই তারামায়ের পুজোয় অঞ্জলি দেওয়ার জন্য আমরা রাত জেগে উপোস করে থাকি। রামকৃষ্ণ পাল, অনিন্দ্য রায়রা জানান, এখন সবেতেই তাঁরা হাত লাগান।মনেই হয় না এক দিন পারিবারিক গণ্ডীতে আবদ্ধ ছিল এই পুজো। আনন্দ রায়, তরুণ চক্রবর্তী, দানবেন্দ্র পালরা আবার বলেন, ‘‘সর্বজনীনতার ছোঁয়া লাগায় উৎসব প্রিয় বাঙালির কাছে দুর্গা থেকে লক্ষীপুজোর ফাঁকটা ভরাট করে দিয়েছে তারামায়ের পুজো।’’
পলাশবাবু এবং আর এক ভ্রাতুপুত্র বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘তারশঙ্কর সর্বজনপ্রিয় সাহিত্যিক। তাঁরই জন্ম উপলক্ষে প্রচলিত পুজো কখনওই পারিবারিক গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকা কাম্য নয়। তাই সবার যোগদানের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তারামাডাঙায় পুজো স্থানান্তরিত করে সর্বজনীন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’’
তবে চরিত্র বদলালেও, বজায় রয়েছে সাবেকিয়ানা। প্রতিমা থেকে উপাচার, আজও একই আছে। আজও সারা গায়ে সাপ জড়ানো বাঘছাল পরিহিতা জটাধারী নীল রঙের মূর্তি পূজিত হয়। নীল সরস্বতী হিসাবেও আখ্যায়িত হন দেবী। উপাচারে থাকে মদ, ছোলাভাজা-সহ নানা সামগ্রী। বদলায়নি পুরোহিতও। পুরুষানুক্রমে ওই পুজো করে আসছেন স্থানীয় কোতলঘোঁষার ভট্টাচার্য পরিবার। পুরুষানুক্রমে এখন পুজো করছেন সুভাষ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘১২০ বছরের প্রাচীন এই পুজোয় নানা ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। বহিরঙ্গেও নানা সময়ে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু পুজোর রীতি আচারের কোনও পরিবর্তন হয়নি কখনও।’’