আলু ব্যবসায়ীদের কর্মবিরতিতে কাজ বন্ধ। তাই সুনসান হিমঘরে আলুর বস্তার উপরেই ঘুমিয়ে পড়েছেন এক শ্রমিক। বুধবার বাঁকাদহে ছবিটি তুলেছেন শুভ্র মিত্র।
রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতের জেরে ধর্মঘটের পথে নেমেছেন আলু ব্যবসায়ীরা। যার খেসারত হিসেবে একদিকে বাজার থেকে বেশি মূল্যে আলু কিনতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। অন্য দিকে, তেমনই পুজোর মুখে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হিমঘরে আলু ঝাড়াইবাছাই এবং আলুর বস্তা গাড়িতে তোলা-নামানোর কাজে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে তার উত্তর নেই কারও কাছেই।
বুধবার সকালে বিষ্ণুপুরের বাঁকাদহের একটি হিমঘরে গিয়ে দেখা গেল হিমঘর চত্বর একেবারে সুনসান। একটি ঘরের বারান্দায় হিমঘরের জনাকয়েক স্থায়ী কর্মী আলু ব্যবসায়ীদের কর্মবিরতি কবে ওঠে তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন সাধনচন্দ্র লায়েক বলেন, “পুজোর আগে ব্যবসা যে ভাবে মার খেল, তাতে এ বার পুজোয় বোনাসও জুটবে কি না, কে জানে।” হিমঘরের এক প্রান্তে দুর্গামুর্তির কাঠামোর উপরে কাদামাটি লেপছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি মুক্ত কয়াল। এই হিমঘরে তিনি আলু লোডিং-আনলোডিং এর কাজ করেন। স্থানীয় এক পুজো কমিটির কাছ থেকে বরাত পেয়ে ঠাকুর গড়ছেন। আগে কাজের ফাঁকে ঠাকুর গড়তেন। এখন কর্মবিরতি চলায় সারাদিন প্রতিমা নিয়েই পড়ে রয়েছেন।
মুক্তবাবুর বাড়ি দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবনের পাথরপ্রতিমা এলাকায়। মুক্তবাবুর কাছে ভিড় করেছিলেন তাঁর এলাকা থেকে এই হিমঘরে কাজ করতে আসা আরও কিছু শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে গৌতম দাস, দীপক গিরি, পলাশ বৈরাগী, বিশ্বজিত্ পাত্র জানান, মুক্তবাবু তাঁদের দলের ৪০ জন শ্রমিকের ‘সর্দার’। জল-জঙ্গলের এলাকা পাথরপ্রতিমায় তেমন চাষাবাদ বা শিল্প না থাকায় পেটের তাগিদে এখানে এসেছেন। আলু বস্তা লোডিং-আনলোডিংয়ে বস্তাপিছু তাঁদের রোজগার চার টাকা। দিনে ৮০ থেকে ১৭০ টাকা রোজগার হয়। সেই টাকাতেই খাওয়াপরা করে হাতে যে যত্সামান্য টাকা থাকে, তা বাড়িতে পাঠান। তাঁদের আক্ষেপ, “গত কয়েকমাস ধরে আলু পরিবহণের ক্ষেত্রে খানাতল্লাশি শুরু হওয়ায় ব্যবসায়ীরা হিমঘর থেকে তুলনায় কম আলু বের করছেন। ফলে আমাদের রোজগারও কমে গিয়েছে। তার উপরে এই দু’দিন ধরে ব্যবসায়ীরা কর্মবিরতি শুরু করায় কাজ একেবারেই বন্ধ। কবে চালু হবে ঠিক নেই। বসে বসে জমানো টাকায় খেতে হাত ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।” তাঁদের খেদ, এ ভাবে কর্মবিরতি ও আলু বিক্রিতে কড়াকড়ি চললে হিমঘর শ্রমিকদের সর্বনাশ হয়ে যাবে। পুজোর সময় খালিহাতে সন্তান ও বাড়ির লোকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। মুক্তবাবু জানান, এলাকায় কাজ নেই বলেই মাসে কয়েক হাজার টাকা রোজগারের জন্য এখানে হিমঘরের মধ্যে কষ্টে তাঁরা পড়ে থাকেন। তাঁর কথায়, “ছেলে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সংসার ও তার পড়ার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছি।”
এই হিমঘরে আলু ঝাড়াই বাছাইয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় ২০০ জন শ্রমিক। তাঁদের বেশিরভাগই স্থানীয় বাসিন্দা। ঝাড়াই বাছাইয়ের কাজ করে তাঁরা দিনে কয়েকশো টাকা রোজগার করেন। কর্মবিরতির জেরে তাঁরাও এখন কর্মহীন। হিমঘর লাগোয়া চৌবেটা গ্রামের বিনোদ বাগ, জগবন্ধু বাজ, প্রশান্ত বাগ, শশাঙ্ক সর্দারের মতো বহু মানুষ এই কাজে যুক্ত। তাঁদের গ্রামে গিয়ে জানা গেল অনেকেই মাঠে জনমজুরের কাজে খাটতে গিয়েছেন। আবার অনেকে কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের মধ্যে বিনোদবাবু ও জগবন্ধুবাবু বলেন, “পুজোর মুখে কাজ খুইয়ে খুব সমস্যায় পড়লাম। আমরা তো দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষ। এমনিতেই বাইরে আলু যাওয়া বন্ধ হয়ে পড়ায় কাজ কম হচ্ছিল। তবুও দিনের শেষে হাতে টাকা আসছিল। একেবারেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হয়ে পড়েছি।”
ফাটা আলুর বস্তা সেলাই করেও হিমঘর থেকে আয় করেন বহু মানুষ। কর্মবিরতিতে তাঁরাও সমস্যায় পড়েছেন। বাঁকাদহের হিমঘরের সঙ্গে এই কাজে যুক্ত চৌবেটা গ্রামের বাসিন্দা শিবরাম পণ্ডিত জমিতে চাষের কাজ করছিলেন। তিনি জানান, ১০০টি ছেঁড়া বস্তা সেলাই করলে ৯০ টাকা পাওয়া যায়। ওই হিমঘরে তাঁরা ন’জন এই কাজ করে সংসার প্রতিপালন করেন। কাজ হারানোয় সকলেরই মাথায় হাত পড়েছে। বাঁকুড়া জেলা হিমঘর মালিক সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, এই জেলায় মোট ৪২টি হিমঘরের মধ্যে বর্তমানে ৩৪টি হিমঘর চালু রয়েছে। কর্মবিরতির জেরে প্রতিটি হিমঘরের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের একই অবস্থা।
কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে হিমঘর মালিকদেরও। হিমঘর মালিক সমিতির জেলা সভাপতি দিলীপ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কর্মবিরতির ফলে আমাদের ব্যবসা একেবারে লাটে ওঠার জোগাড় হয়েছে। যে ভাবে আলু হিমঘরে জমতে শুরু করেছে, আগামী দিনে চাহিদার তুলনায় মজুত আলু বেড়ে যাবে। তখন ব্যবসায়ীরা আর আলু বের করবে না। কম দামে ক্ষতি করে বাজারে আমাদের সেই আলু বিক্রি করতে হবে।” তাঁর দাবি, বছরের পর বছর সরকার ও আলু ব্যবসায়ীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটছে। এর সুষ্ঠু সমাধান না হলে সঙ্কট বাড়বে। জেলার বহু হিমঘরও বন্ধ হয়ে যাবে। তবে হিমঘরের স্থায়ী কর্মীদের এ বার বোনাস পাওয়া নিয়ে সমস্যা হবে না বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন।
কর্মবিরতি তুলে নেওয়ার ব্যাপারে নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারেননি জেলার আলু ব্যবসায়ীরা। পশ্চিমবঙ্গ প্রগতিশীল আলু ব্যবসায়ী সমিতির রাজ্য কমিটির সদস্য তথা বাঁকুড়া জেলা কমিটির পরামর্শদাতা রঘুপতি সেন বলেন, “রাজ্য সরকার একাধিক বার বৈঠকে বসার আশ্বাস দিলেও বৈঠক করেননি। ফের ডেকেছেন। কিন্তু আমাদেরও খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের সমস্যার কথা জানি। নিতান্ত বাধ্য হয়ে কর্মবিরতির পথে যেতে হয়েছে।”