রথ ছোট না বড়, কাগজের তৈরি, কাঠের তৈরি নাকি পিতলের তৈরি, ভাঙা নাকি নতুন— সেটা বড় কথা নয়। রথযাত্রা উৎসবটাই বড় হয়ে উঠল বুধবার জেলাজুড়ে। জেলাজুড়ে জমে উঠল রথের মেলা।
দুপুর গড়াতেই পথে কালো মাথার ভিড়। বাঁশি, বেলুন, মাটির পুতুল, ঘর সাজানোর টুকিটাকি তো পথের দু’পাশে আছেই, সঙ্গে জিলিপি, বাদাম ভাজা আর পাঁপড় ভাজার গন্ধ। নলহাটি থেকে বোলপুর, দুবরাজপুর এ দিন সন্ধ্যা গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত সর্বত্রই এক উৎসবের ছবি।
জেলার বড় এবং ঐতিহ্যশালী রথের তালিকায় যে কয়েকটি রথ রয়েছে সেই তালিকায় পড়ে হেতমপুর রাজবাড়ির রথ। রাজকীয়তা হয়ত এখন আর নেই, ইংল্যাণ্ডে তৈরি হেতমপুর রাজবাড়ির শতাব্দী প্রাচীন পাঁচ চূড়া বিশিষ্ট রথের আকর্ষণ এখনও অটুট। সোনার মতো ঝকঝকে রথটি বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। গত বছর দেশজুড়ে পুরাকীর্তি, মন্দির সংস্কার, পুঁথি পুনরুদ্ধারের মতো কাজে আগ্রহী একটি এনজিও রথটির সংস্কারের কাজ করায় হৃত রূপ ফিরে পেয়েছে রথটি। রথটি তার হৃত রূপ ফিরে পাওয়ার পর গতবছর রথের রশি ধরে টেনেছিলেন রাজা মাধবী রঞ্জন চক্রবর্তী।
তিনিও গত হয়েছেন। এ বার অবশ্য রশিতে টান দিয়েছেন প্রয়াত রাজার দুই মেয়ে অনুরাধা ও বৈশাখী। অন্যান্য বারের মতো এ বারও গৌরাঙ্গ মন্দির থেকে (যেটি বর্তমানে গৌরীয় মঠের তত্ত্বাবধানে রয়েছে) রথ বেড়িয়ে রাজবাড়ি ছুঁয়ে গ্রামের রাস্তায় পৌঁছলে সঙ্গ নেয় জনস্রোত।
এ বারও এই রথকে ঘিরেই মেলা বসে। সে মেলাতে স্থানীয় মানুষের ভিড় ছিল জমজমাট।
নলহাটির বড়লা গ্রামে জমিদারবাড়ির রথও একসময় বিখ্যাত ছিল। একটি নয় দুটি রথ বের হত এই দিনটিতে। একটি পিতলের, অন্যটি কাঠের। গ্রামেই রথতলার মাঠে সাত পাক করে ঘোরানো হত রথ। রথে অধিষ্টিত হত কুলদেবতা রামচন্দ্রের মূর্তি। বসত মেলা। সেই রেওয়াজ একই আছে। মেলাও বসে। কিন্তু জমিদারবাড়ির অর্থনৈতিক সঙ্কটের সঙ্গে সঙ্গে রথগুলি বেহাল। কাঠের রথটি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পিতলের রথ থেকে পিতলের চাদর অনেক আগেই খোওয়া গিয়েছে। ওই কাঠামোতে কাঠ দিয়ে রথ তৈরি করে চলছে। এমন জানিয়েছেন, জমিদারবাড়ির উত্তরপুরুষ মঙ্গলময় রায় চৌধুরী।
জৌসুস হয়তো হারিয়েছে, কিন্তু এলাকার তিনটে অঞ্চলের মানুষ এখনও এই রথকে ঘিরেই উৎসবে মাতেন।
রামপুরহাটে খরবোনা গ্রামে রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে (এলাকাবাসী ঠাকুরবাড়ি বলেন) একটি প্রাচীন রথ রয়েছে। রথটি পিতলের। রয়েছে সিংহ পরিবারের কাঠের তৈরি রথ। আর রয়েছে ইস্কনের রথ। এলাকার মানুষ রথযাত্রা ঘিরে আনন্দে মাতেন। বোলপুর শহরে রয়েছে বড় পাঁচটি রথ। ছোট ছোট রথ নিয়ে সংখ্যাটি একডজন পেরিয়ে যাবে। প্রাচীন রথগুলোর মধ্যে রয়েছে মকরমপুরে ভোলা চাঁদ রথ। হরগৌরী তলার জীবনকুমারের রথও রয়েছে। সবকটি রথই শহর পরিক্রমা করে। এবং বিকালের পর থেকে শহরের চৌরাস্তায় উপর দিয়ে যায়। তাই রথ দেখতে সেখানে ভিড় জমান শহরবাসী। রাস্তার ধারে বসে যায় ছোট মেলা।
সিউড়ি শহরের রাধাবল্লভ মন্দির থেকে বের হয় একটি প্রাচীন রথ। রয়েছে রামকৃষ্ণ আশ্রমের ঠাকুর সত্যানন্দ রথটিও. এছাড়া বারুইপাড়া ডাঙালপাড়া, সিউড়ির কড়িধ্যায় বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত মন্দির থেকে রথ বের হয়। শহর ঘুরে রাধাবল্লভ মন্দিরের রথ যায় সিউড়ি পুরোনো ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের কাছে। অন্যদিকে রামকৃষ্ণ আশ্রমের রথটি সিউড়ির মৌমাছি ক্লাব পর্যন্ত আসে। সাঁইথিয়া শহরে প্রাচীন রথ বলতে সূত্রধর ও দাস পরিবারের দুটি কাঠের তৈরি রথ। আগে এই রথদুটিকে ঘিরেই উৎসবে মাততেন শহর ও আশপাশের মানুষ।
তিন দশক আগে নন্দীকেশ্বরী মন্দির থেকে রথযাত্রা উৎসব পালন শুরু হওয়ার পর থেকে এই রথটিই মূল আকর্ষণ কেড়ে নিয়েছে। এলাকায় বসে মেলা। নন্দীকেশ্বরী রথের মেলা কমিটির সম্পাদক প্রমোদ অগ্রবাল বলেন, ‘‘কবেকার রথ, মেলায় ৩১টি স্টল এসেছে। রয়েছে নাগরদোলা। এলাকবাসী খুব আনন্দ করেন।’’
মহম্মদবাজার এলাকায় এবং গণপুরে দুটো রথকে ঘিরেও সামন উৎসাহ এলাকার মানুষের। হেতমপুর ছাড়া দুবরাজপুরে রথে প্রবল উৎসাহ রয়েছে শহরের মধ্যে দুটি রথকে ঘিরে। একটি দুবরাজপুর রামকৃষ্ণ আশ্রমের কাঠের তৈরি রথ। অন্যটি মহাপ্রভূ মন্দিরের লোহার রথ। হেতমপুর ও দুবরাজপুর পাশাপাশি হওয়ায় কয়েক হাজার মানুষের ভিড় জমে রাস্তায়। এ বারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুধু প্রতিষ্ঠিত মন্দির বা পরিবারের সদস্যরা রথ নিয়েই আনন্দ করেন এমনটা নয়। পিছিয়ে নেই কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনীও। বছর চারেক ধরে মাও দমনে নলহাটি এলাকায় নলাটেশ্বরী পাহাড়ে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সিআরপিএফের ব্যাটলিয়ন তা করে দেখিয়েছে এ বারও। এ বারও গোটা নলহাটি শহরে ঘোরে সেই রথ। ব্যাঘাত ঘটায়নি এ বার বৃষ্টিও।
রথের ছবিগুলি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়, সব্যসাচী ইসলাম, সোমনাথ মুস্তাফি, বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।