লিজ জমিতে অবৈধ নির্মাণ, চুপ প্রশাসন

তিনি রাজ্যের এক মন্ত্রীর আপ্ত সহায়কের ঘনিষ্ঠ। তাই সরকারের কাছ থেকে লিজে পাওয়া একটি জমিতে অবৈধ নির্মাণ করেও তৃণমূলের এক নেতা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে। এমনকী, তদন্ত কমিটি নির্মাণ ভেঙে ফেলার সুপারিশ করলেও, জেলা প্রশাসন তা কার্যকরও করেনি। পুরভোটের মুখে এমনই অভিযোগকে ঘিরে ফের সরগরম হয়ে উঠেছে বোলপুর শহরের রাজনীতি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বোলপুর শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৫ ০১:৫৬
Share:

এই জমি ঘিরেই বিতর্ক। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।

তিনি রাজ্যের এক মন্ত্রীর আপ্ত সহায়কের ঘনিষ্ঠ। তাই সরকারের কাছ থেকে লিজে পাওয়া একটি জমিতে অবৈধ নির্মাণ করেও তৃণমূলের এক নেতা ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন বলে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে। এমনকী, তদন্ত কমিটি নির্মাণ ভেঙে ফেলার সুপারিশ করলেও, জেলা প্রশাসন তা কার্যকরও করেনি। পুরভোটের মুখে এমনই অভিযোগকে ঘিরে ফের সরগরম হয়ে উঠেছে বোলপুর শহরের রাজনীতি।

Advertisement

ঠিক কী ঘটেছে?

কৃষি বিপণন দফতর সূত্রের খবর, ২০১১ সালে বাম আমলের শেষ দিকে বোলপুরের নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির আওতাধীন প্রায় ১,৯৪০ বর্গফুটের একটি জমি লালু মির্ধা নামে নানুর থানার পাটনিল এলাকার এক বাসিন্দাকে লিজ দেওয়া হয়। জমিতে কোনও স্থায়ী নির্মাণ করা যাবে না, জমির রূপ পাল্টানো যাবে না-সহ একাধিক শর্ত চুক্তিতে আরোপ করা ছিল। নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির তৎকালীন কর্তৃপক্ষ ওই লিজ চুক্তিতে জমির ভাড়া বাবদ বর্গফুট পিছু তিন টাকা করে ধার্য করে। লালু মির্ধার ক্ষেত্রে ৫,৬০০ টাকা মাসিক ভাড়া নির্ধারিত করা হয় বলে জানা গিয়েছে। সরকারি কোনও জমি লিজ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের পাওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ভাড়া ধার্য হয়। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে সেই নিয়ম মানা হয়নি বলে দাবি করা হচ্ছে। অভিযোগ, নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির তৎকালীন সহ-সভাপতি তথা ফরওয়ার্ড ব্লকের দাপুটে নেতা অভিজিৎ (রানা) সিংহের ঘনিষ্ঠ হওয়াতেই বাজারমূল্যের থেকে কয়েক গুণ কম ভাড়ায় লালুবাবুকে ওই জমি লিজে দিয়ে দেওয়া হয়।

Advertisement

দল ও স্থানীয় সূত্রের খবর, রাজ্যে পালা বদলের পরেই অভিজিৎবাবুর হাত ধরে লালু মির্ধাও তৃণমূলে যোগ দেন। অভিজিৎবাবু বর্তমান রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের আপ্ত সহায়ক এবং তৃণমূলের অন্যতম জেলা সাধারণ সম্পাদক। লিজ লেনদেনের সময়ে চন্দ্রনাথবাবু ছিলেন বোলপুরের পুরপ্রধান এবং নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির সদস্য। অভিযোগ, ওই শর্তের তোয়াক্কা না করেই লিজের জমিতে দিনের পর দিন নির্মাণ কাজ করেছেন লালুবাবু। বোলপুরের মহকুমা প্রশাসনিক ভবনের সামনে ওই জমিতে কার্যত একটি ছোটখাটো বাজার গড়ে তোলা হয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় বেআইনি ভাবে এমন নির্মাণ কাজ কীভাবে হল, সে সম্পর্কে অবশ্য চুপ বোলপুর মহকুমার পুলিশ-প্রশাসন। নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির বর্তমান কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, এই অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে এবং অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য স্থানীয় থানা থেকে শুরু করে এসডিও, জেলাশাসক এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর কাছে বারবার আবেদন করেও কোনও লাভ হয়নি।

কৃষি বিপণন দফতর সূত্রের খবর, ২০১৩ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমে নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতি লালুবাবুকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে। দিন কয়েক পরে দফতরে ডেকে বেআইনি কাজ নিয়ে জবাবদিহিও চায়। তাতেও কোনও কাজ না হওয়ায় দফতর লিখিত নোটিসও পাঠায়। অভিযোগ, তাতেও কান দেননি শাসকদল ঘনিষ্ঠ লালু মির্ধা। শেষমেশ একই মাসের শেষ সপ্তাহে বোলপুর থানায় এই মর্মে লিখিত অভিযোগও জমা পড়ে। জানানো হয় বোলপুরের এসডিপিও এবং মহকুমাশাসককে। কিন্তু, তার পরেও দেখা যাচ্ছে সরকারি জমিতে রমরমিয়ে চলছে বেসরকারি মার্কেট।

জানা গিয়েছে, বিষয়টি দফতরের মন্ত্রী অরূপ রায়ের কানে গেলে, তাঁর নির্দেশে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠিত হয়। সংশ্লিষ্ট দফতরের আইনি পরামর্শদাতা, ইঞ্জিনিয়র এবং সিনিয়র মার্কেটিং ডেভলপমেন্ট অফিসারকে নিয়ে গঠিত কমিটি ওই নির্মাণকে বেআইনি ঘোষণা করে। এর পরেই দফতর স্থানীয় থানা এবং জেলা প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলে। কিন্তু, আজও কোন পদক্ষেপ করা হয়নি বলেই অভিযোগ। বোলপুর পুরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কংগ্রেসের প্রার্থী ফারুক অহমেদ, বিজেপি-র কিশোর দাস এবং সিপিএমের সৌরভ রায়ের দাবি, ‘‘রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেই তৃণমূলের ওই কর্মী এমনটা করতে পারছেন। শাসকদলের নেতাদের ভয়ে পুলিশ-প্রশাসনও এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তৃণমূলের এই দুর্নীতির কথা আমরা নাগরিকদের সামনে তুলে ধরছি।’’

দফতর সূত্রেরই খবর, নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির ওই লিজের জায়গায় একটি খাবারের দোকান বা ক্যান্টিন অস্থায়ী ভাবে চালানোর কথা ছিল। অথচ বর্তমানে তিন হাজার বর্গফুট ওই জমির উপরে ন’টি দোকান ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে গাড়ি সার্ভিসিং কেন্দ্র, সিমেন্ট গুদাম, স্টাডি সেন্টার, কম্পিউটার-জেরক্স প্রভৃতি দোকান তৈরি হয়েছে। ঘরগুলি ভাড়া দিয়ে মাসিক মাত্র ৫,৬০০ টাকা সরকারের ঘরে জমা করে প্রতি মাসে লালুবাবু প্রায় ৫০ হাজারের বেশি টাকা রোজগার করছেন বলে বিরোধীদের দাবি। আবার অতীতে লালুবাবুর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও উঠেছে, তিনি ওই সামান্য লিজের টাকাও নিয়মিত ভাবে দেন না। যাঁর বিরুদ্ধে এত অভিযোগ, সেই লালুবাবুর সঙ্গে সোমবার যোগাযোগ করা হয়েছিল। সমস্ত অভিযোগই তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। উল্টে, তাঁর দাবি, ‘‘যা করেছি, প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র নিয়েই করেছি।’’

অন্য দিকে, যাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পুলিশ-প্রশাসন এ ব্যাপারে এগোনোর ,সাহস দেখাচ্ছে না বলে বিরোধীদের অভিযোগ, সেই অভিজিৎ সিংহ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। নিশ্চুপ এসডিপিও (বোলপুর) অম্লানকুসুম ঘোষ এবং জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমারও। তবে, চন্দ্রনাথবাবুর দাবি, ‘‘বিষয়টি নিয়ে আমি বিশেষ কিছু জানি না। তবে, তৃণমূল এ ক্ষেত্রে কোনও প্রভাব খাটাচ্ছে না।’’ আর নিয়ন্ত্রিত বাজার সমিতির সচিব আকবর আলি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে জেলাশাসকের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে।’’ জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী জানান, বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আছে। খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনার কথা জানিয়ে যোগাযোগ করা হলে রাজ্যের কৃষি বিপণন দফতরের মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “পুলিশ, জেলাশাসক-সহ সংশ্লিষ্ট দফতরে অভিযোগ জানানো হয়েছে। ওই অবৈধ নির্মাণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবেই।”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement