রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বামী বিবেকানন্দ। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার আর্কাইভ থেকে
বয়সের ফারাক মাত্র দু’বছর। একে অপরের জন্মভিটেও মাত্র মাইল দেড়েক দূরে। তা সত্ত্বেও কি দু’জনের পরিচয় ছিল না? অবশ্য পরিচয় ছিল না বললেও কি খুব ঠিক বলা হয়? মুখোমুখি সংবাদের অকাট্য প্রমাণ ইতিহাস আমাদের জন্য না রাখলেও তাঁরা যে একে অপরের গুণগ্রাহী ছিলেন সে বিষয়ে তো সন্দেহ থাকে না। আমরা কথা বলছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী বিবেকানন্দকে নিয়ে।
দু’বছরের ব্যবধানে দু’জনের জন্মের সার্ধশতবর্ষ পেরিয়ে গিয়েছে। একজনের জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে, অন্যজনের জন্ম কলকাতার কাছেই সিমলা স্ট্রিটে, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে। দু’জনে কি দু’জনার কাছে আসতে পেরেছেন কখনও? অবশ্য এ নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আগে, পরে এবং সমকালীন বিভিন্ন মনীষী, বৈজ্ঞানিক ও মহান মানুষের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত বলে জানা যায়। অথচ বিবেকানন্দের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ হয়নি বা প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ ঘটেনি এমনটা ভাবা বড় অদ্ভুত ঠেকে।
রবীন্দ্রনাথের ভাইপো দ্বিপেন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে ছিলেন তিনি অবশ্য বিবেকানন্দের শৈশব বন্ধু। তখন তিনি নরেন, স্বামী বিবেকানন্দ হননি। দ্বিজেন্দ্রনাথের আসরে নরেন আসেন নানা বিষয়ে আলোচনা ও গল্প করতে। নিত্য যাতায়াতের ফলে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে নরেনের পরিচয় হয়। দেবেন্দ্রনাথ প্রথম দর্শনেই পুত্রতুল্য এই যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হন। নরেনও এই মহর্ষির আচরণ ও নীতিনিষ্টায় শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। এমনকি, বিবেকানন্দের “সংগীত কল্পতরু”তে রবি ঠাকুরের ১২টি গানও সংকলিত হয়েছে, যেগুলি নরেন ঠাকুর রামকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে গেয়ে শোনাতেন।
বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুলাই শোনান- ‘তোমারই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’, ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’, ‘মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত’ প্রভৃতি। কিন্তু উভয়ের মধ্যে কোন প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়েছিল কি না, তা কুয়াশাচ্ছন্ন রয়ে যায়।
দেবেন্দ্রনাথের কাছে নরেন্দ্রনাথের বার বার আসা যাওয়া সেই সময়ে তাঁর মনের যে গভীর আধ্যাত্মিক সংকটের উপস্থিত হয়েছিল সে কথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করেছেন। একদিন “প্রাণের উৎকণ্ঠা নিয়ে স্বামীজী মহর্ষির কাছে উপস্থিত হলেন”। তিনি যে ব্রাহ্ম সমাজে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সেকথা জীবনীকার প্রমথ বসু উল্লেখ করে বলেছেন, ‘নরেন্দ্র ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করিতে করিতে ক্রমে রীতিমতো খাতায় নাম লিখইয়ে ব্রাহ্ম সমাজভুক্ত হইলেন। এমনকি যখন তিনি স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্ববিখ্যাত হইয়াছেন তখনো হয়তো ব্রাহ্মদিগের খাতায় নাম ছিল’ (স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমভাগ- প্রমথনাথ বসু)। যাই হোক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাৎকারের সেরকম কোনও তথ্যভিত্তিক ঘটনার উল্লেখ না পাওয়া গেলেও এ বিষয়ে নিবেদিতার ভূমিকাটি অস্বীকার করা যায় না। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ ৩০শে জানুয়ারি (১৮ মাঘ) মঙ্গলবার জোসেফিন ম্যাকলাউডকে লেখা নিবেদিতার একটি পত্রে জানা যায় নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে মাঘোৎসবে বা অন্য কোনও সংগীত সভায় রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সভায় রবীন্দ্রনাথ দু’টি গানও গেয়েছিলেন। কিন্তু কোনও কথাবার্তা হয়নি। নিবেদিতাও লিখেছিলেন, ‘only there was some cloud- I could not tell what’. মেঘই থেকে গেল, আকাশ পরিষ্কার হল না। কিন্তু রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহসভায় ‘ব্রাহ্ম সুকবি’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ দুটি গান রচনা করেছিলেন তার একটি হল- “দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি বল দেব! কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়’’।
বলা বাহুল্য দু’টি হৃদয়ের নদী কোথাও মিলিত হল না। নরেন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ হওয়ার পর শাক্ত ধর্মের উপাসক হয়ে উঠলেন, অপর দিকে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মের হয়েও সর্বোপরি মানবধর্মের কবি। আবার আমেরিকার শিকাগো ভাষণে বিবেকানন্দের মতো মানবধর্মের উপর বড় ভাষণ খুব কমই শোনা যায়। অথচ আশ্চর্যের বিষয় রবীন্দ্র সৃষ্টির মধ্যে বিবেকানন্দের প্রতিফলন তাঁর জীবিত ও মৃত্যুর পরও বহু জায়গায় লক্ষ্য করা যায়। এমনকি, বিবেকানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর শোকসভাতেও রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রায় নীরব ও উদাসীন থেকেই গিয়েছেন। এ ছাড়া এ প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ, জাপানের বিখ্যাত কবি ওকাকুরা এবং রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গটি খুব গুরুত্বপুর্ণ। ভারতবর্ষকে বুঝতে ওকাকুরা বিবেকানন্দের কাছে গেলে তিনি বলেছিলেন- “এখানে আমার সঙ্গে আপনার কিছুই করণীয় নেই। এখানে তো সর্বস্ব ত্যাগ। রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে যান। তিনি তখনো জীবনের মধ্যে আছেন”। ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে গিয়েছিলেন। এই কথা বিবেকানন্দের রবীন্দ্রপ্রতিভা ও সৃষ্টি কর্মকে সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অপর দিকে ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন- “ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative”. (Chintanayak Vivekananda pg.981)।
পরবর্তী কালের ইতিহাস কিন্তু অন্যরকম দু’জনের জীবন মোড় নিল দু’দিকে। একজন সমগ্র বিশ্বকে সৃষ্টির সূতোয় মালা গাঁথলেন, নোবেল পেলেন, এশিয়া মহাদেশে ভারতকে সবাই চিনল আর অন্যজন ভারতকে বিশ্বের দরবারে বিভিন্ন দিক থেকে মহান করে তুললেন বিশেষ করে ধ্যানে, ত্যাগে, সেবায়। তারই আরাধনায় আমরা সবাই মেতে উঠি। তাই বিবেকানন্দের ১৫৭ তম জন্ম শতবর্ষে নানা আলোচনার মধ্যে এই বিষয়ে কোথাও যদি আলোকপাত হয়, তবে একটি নির্ভেজাল সত্য উদ্ঘাটিত হবে।
শালডিহা কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান