জালিয়াতির ছায়া পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর সাধের কন্যাশ্রী প্রকল্পে। বাঁকুড়ার মগরা হাইস্কুলের পাঁচ ছাত্রীর কন্যাশ্রী প্রকল্পে পাওয়া ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠল এক ‘ব্যাঙ্ক মিত্র’-র বিরুদ্ধে। প্রশাসনের আধিকারিকদের জেরার মুখে পড়ে অপরাধ কবুল করে প্রাপকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন ওই ব্যক্তি। তবে তাতে কাজ হয়নি। প্রশাসনিক স্তরে তদন্তের পরে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছে জেলা প্রশাসন।
কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় থাকা ছাত্রীদের ১৩ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত বছরে ৫০০ টাকা দেয় রাজ্য সরকার। ১৮ বছর পূর্ণ হলে এককালীন ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। নগদে নয়, এই টাকা সরাসরি তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধা প্রাপকেরা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে ভিড় বাড়বে। তা সামাল দিতে গিয়ে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা শ্লথ হয়ে পড়তে পারে। সেই পরিস্থিতির কথা ভেবে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ‘ব্যাঙ্ক মিত্র’ পদে অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে। এই কর্মীদের কাজ, গ্রামে গ্রামে গিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া। নতুন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে শুরু করে এই কর্মীদের সঙ্গে থাকা মিনি এটিএম থেকে টাকাও তোলা যায়। এর ফলে সাধারণ মানুষের হয়রানি কমে।
এ ক্ষেত্রে বাঁকুড়া শহরের মানকানালিতে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখার ব্যাঙ্ক মিত্র মুরলী কর্মকারের দৌলতে হয়রানি কমার বদলে বেড়েছে বলে অভিযোগ। ওই শাখা থেকেই মগরা হাইস্কুলের ছাত্রীরা কন্যাশ্রী প্রকল্পের টাকা পায়। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুকেশ পাত্র জানান, বছর দু’য়েক আগে কন্যাশ্রী প্রকল্পের উপভোক্তা স্কুলের পাঁচ ছাত্রী আঠারো পেরিয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ প্রাপ্য পঁচিশ হাজার টাকা পায়নি। প্রাপক ছাত্রী অন্তরা কর্মকার, তনু সিংহবাবু, শিখা সিংহবাবুদের অভিযোগ, ‘‘ব্যাঙ্কে যতবার খোঁজ নিতে গিয়েছি, বলা হয়েছে টাকা নাকি জমাই পড়েনি।’’ শেষে গত শুক্রবার ওই ছাত্রীদের অ্যাকাউন্টে দু’বছরে হওয়া লেনদেনের খতিয়ান চাওয়া হয় ব্যাঙ্কের থেকে। আর সেই নথি হাতে পেতেই চোখ কপালে ওঠে স্কুল কর্তৃপক্ষের।
মুকেশবাবু জানান, নথিতে দেখা যায়, বছর খানেক আগে ওই ছাত্রীদের অ্যাকাউন্টে ২৫ হাজার টাকা করে জমা পড়েছিল। কিন্তু এক মাস কাটতে না কাটতেই ছাত্রীরা নাকি সেই টাকা তুলেও নিয়েছে! ছাত্রীরা টাকার মুখ দেখল না, কিন্তু সেই টাকা তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা হয়ে গেল! মুকেশবাবু শনিবার বিষয়টি জেলা প্রশাসনের আধিকারিকদের জানান। এই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই আবার শনিবার রাতারাতি অ্যাকাউন্টে টাকা ফেরত চলে আসে। পাসবই আপডেট করে দেখা যায় ছাত্রীরা নিজেরাই নাকি টাকা ফের জমা করেছে। রহস্যের কূল কিনারা না পেয়ে সোমবার স্কুলের তরফে জেলাশাসক এবং কন্যাশ্রী দফতরে লিখিত অভিযোগ করা হয়।
ওই দিনই ব্যাঙ্কের শাখা কার্যালয়ে তদন্ত করতে যান বাঁকুড়া ২ ব্লকের ভারপ্রাপ্ত ওসি (কন্যাশ্রী) পার্থসারথি কর এবং ওই ব্লকের পঞ্চায়েত উন্নয়ন আধিকারিক সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক ম্যানেজার এবং অভিযুক্ত ব্যাঙ্ক মিত্রের সঙ্গে আলোচনায় বসেন আধিকারিকেরা। তাঁদের দাবি, জেরায় ভেঙে পড়েন ব্যাঙ্ক মিত্র মুরলীবাবু। স্বীকার করে নেন, তিনিই ওই টাকা তুলেছিলেন। তবে স্বীকারোক্তিতে চিঁড়ে ভেজেনি। জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু এ দিন বলেন, “অভিযুক্ত নিজের দোষ স্বীকার করে মুচলেকা দিয়েছেন। তুলে নেওয়া টাকা ওই ছাত্রীদের অ্যাকাউন্টে ফেরতও দিয়ে দিয়েছেন তিনি। তবে এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে আমরা কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’’ তিনি জানান, পুলিশ এবং ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষকে পুরো বিষয়টি জানানো হয়েছে।
কিন্তু নিছক সই জাল করে এই তছরুপ সম্ভব নয়। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কন্যাশ্রী প্রকল্পের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে খুলতে হয়। সে ক্ষেত্রে গ্রাহকের আঙুলের ছাপ না মিললে টাকা তোলা সম্ভব নয়। এই আঁটোসাটো ব্যবস্থার ফাঁক গলে মুরলীবাবু কী ভাবে ওই ছাত্রীদের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুললেন, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ব্যাঙ্কটির ওই শাখার ম্যানেজার রাজেশকুমার মিনা বলেন, ‘‘ব্যাঙ্ক মিত্র অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আদৌ ওই ছাত্রীদের আঙুলের ছাপ নিয়েছিলেন, নাকি জালিয়াতি করে সেই জায়গায় নিজের চেনাজানা কারও আঙুলের ছাপ বসিয়ে দিয়েছিলেন, তা তদন্ত করে দেখা হবে।’’ মুরলীবাবুর থেকে আঙুলের ছাপ নেওয়ার যন্ত্র, মিনি এটিএম-সহ যাবতীয় যন্ত্র ও নথি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। রাজেশবাবুর কথায়, “স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছেন। ব্যাঙ্কের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়েনি। অভিযোগ পেলে ব্যাঙ্কও পদক্ষেপ করবে।’’
কন্যাশ্রী প্রকল্পে দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসতে আলোড়ন পড়েছে প্রশাসনের অন্দরেও। সূত্রের খবর, জেলাশাসক এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের আরও সচেতন হওয়ার এবং নিয়মিত সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেন। জেলাশাসক জানান, পুলিশের কাছে করা অভিযোগের প্রতিলিপি জেলার সমস্ত ব্যাঙ্কেও পাঠানো হয়েছে। এ বার থেকে কন্যাশ্রী প্রকল্পের প্রাপক ছাত্রীদের পাসবই যাতে নিয়মিত আপ টু ডেট করা হয়, সে বিষয়েও ব্যাঙ্কগুলিকে জানানো হবে। প্রশাসনের এক আধিকারিকের মতে, ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকেরা অনেকেই ব্যাঙ্কের নিয়মকানুন জানে না। আর তার সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি হয়। ফলে তাদেরও এই বিষয়ে সচেতন করা প্রয়োজন।
এই প্রসঙ্গে বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী বলেন, “কন্যাশ্রী মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এই প্রকল্পে দুর্নীতি হলে প্রশাসন ছেড়ে কথা বলবে না।” এ দিন চেষ্টা করেও মুরুলীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তাঁর ফোন বন্ধ ছিল। বাড়ি গিয়ে খোঁজ করলে নিজেকে মুরলীবাবুর মা বলে দাবি করে এক প্রৌঢ়া বলেন, “ছেলে সকাল থেকেই বেরিয়েছে। এখনও ফেরেনি। জানি না কোথায় গিয়েছে।” পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।