বৃষ্টিতে এলাকা জলমগ্ন ছিলই। এ বার তিলপাড়া থেকে ছাড়া জল বন্যার আশঙ্কা বাড়িয়ে দিল ময়ূরাক্ষী নদী সংলগ্ন জেলার দুই গুরুত্বপূর্ণ ব্লক সাঁইথিয়া ও মহম্মদবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকায়।
প্রশাসন সুত্রের খবর, এ বছর শুরু থেকেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হওয়ায় খালবিল, নদীনালা ও সমস্ত জলাধার জলে ভরে গিয়েছে। তার উপর দিন কয়েক ধরে অতি বৃষ্টি হয়েছে। আবার আবহাওয়া দফতর থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় দক্ষিণবঙ্গ ও মশানজোড়ের ‘ক্যাচমেন্ট’ এলাকায় প্রবল বৃষ্টি হতে পারে। এ দিকে, ময়ূরাক্ষী নদীর তিলপাড়া জলাধার থেকে গত কয়েক দিন থেকে কম কম করে জল ছাড়া হচ্ছিল। কিন্তু, পরিস্থিতির চাপে শুক্রবার সকালে ৬২ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যার আশঙ্কায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে। রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। সেচ দফতরের জেলা এগকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার কিংশুক মণ্ডল বলেন, ‘‘মশানজোড় জলাধারে ৩৯৮ ফুট জল ধারণের ক্ষমতা। এখন ৩৯২ ফুট জল আছে।’’
ঘটনা হল, তিলপাড়া জলাধারের পর থেকে সাঁইথিয়ার আগে পর্যন্ত ময়ূরাক্ষী ও কানা নদীর মাঝে সিউড়ি, মহম্মদবাজার ও সাঁইথিয়ার ১১টি গ্রাম আছে। ওই সব গ্রামের মানুষ আতঙ্কের প্রহর গুনছেন। গ্রামের চতুর্দিকে নদীর জলে থইথই করায় কেউ-ই বাইরে বের হতে পারছেন না। বাসিন্দাদের দাবি, গ্রামের চার দিকে নদীর জল দু’কুল ছাপিয়ে এগিয়ে আসছে। সেতু না থাকায় গ্রাম থেকে বের হওয়ার কোনও উপাই নেই। স্থানীয় গোবিন্দপুর গ্রামের তৃণমূল নেতা শেখ আরিবুল হক বলেন, ‘‘বুধবার রাতে আদিবাসী পাড়ার তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র, বছর দশকের কৃষ্ণ কিস্কুর পেটে ব্যাথা শুরু হয়। গ্রামে কোনও চিকিৎসক নেই। এ দিকে ভরা নদীতে সে রাতে কড়াইয়ে করে পারাপারের ঝুঁকি কেউ নিতে চাননি।’’
কিন্তু, পরের দিন সকালে কৃষ্ণ যত ক্ষণে সাঁইথিয়া গ্রামীণ হাসপাতালে পৌঁছয়, তত ক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছিল বলে আরিবুলের দাবি। তাঁর তাঁর আরও ক্ষোভ, গ্রামে একটি নৌকো পর্যন্ত নেই। ব্লক প্রশাসনের কাছে বারবার নৌকো চেয়েও ফল মেলেনি বলে তিনি জানান। মৃত কৃষ্ণর বাবা কঙ্কা কিসকু ও মা কালীদেবী এ দিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘‘ছেলেটা যন্ত্রণায় বিনা চিকিৎসায় ছটফট করতে করতে মারা গেল। নদীতে জল থাকায় চিকিৎসার জন্য সাঁইথিয়া, সিউড়ি কোথাও নিয়ে যেতে পারলাম না।’’
আতঙ্কের পাশাপাশি প্রশাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে স্থানীয় কুলতোড়, ঘাষবেড়া, কাটুনিয়া, কুলিয়াড়া, বড়াম, বেহিড়া, ভেজেনা গ্রামগুলিতেও। ওই সব গ্রামের বাসিন্দা অরুণ মণ্ডল, আলাউদ্দিন খানরা বলেন, ‘‘দুর্ভোগের শেষ নেই। আতঙ্কে গত ক’রাত থেকে চোখে ঘুম পর্যন্ত নেই। নদীর দু’পাশের বাঁধে যে ভাবে ধস নামা শুরু হয়েছে, তাতে আমরা খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।’’ এ দিকে, সাঁইথিয়ার দেড়িয়াপুর পঞ্চায়েতের বৈদ্যপুর, রানিপুর, রায়হাট, কালা, দৈকোটা, হরিসরা পঞ্চায়েতের ভবানীপুর, যশোদা, মতিপুর, রুদ্রনগর ইত্যাদি বিস্তীর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের দাবি, কানা ও ময়ূরাক্ষী নদীর বাঁধগুলির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। বন্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
এ দিকে, আতঙ্ক গ্রাস করেছে মহম্মদবাজারের গামিরা, রাউতড়া-সহ নিচু এলাকাতেও। এলাকার বাসিন্দা জিয়া শেখ, দিবাকর মণ্ডলরা বলেন, ‘‘প্রশাসন তো সতর্ক করেই খালাস। আর আমরা সব সময় আতঙ্কে আছি। এই বুঝি সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে চলে যাবে। গত সপ্তাহের ক্ষতই এখনও শুকায়নি। তার মাঝেই ফের বন্যার আতঙ্ক। আর ভাবতে পারছি না।’’
প্রশাসন অবশ্য সব রকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত বলে দাবি করছে। সাঁইথিয়া বিডিও অতনু ঝুরি এবং মহম্মদবাজারের বিডিও সুমন বিশ্বাস বলেন, ‘‘সমস্ত নিচু এলাকার বাসিন্দা ও সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতগুলিকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কাছে নৌকো দেওয়ার আবেদন জানানো হয়েছে।’’