ফাইল চিত্র।
প্রশাসনিক কর্তাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত এক দশকে মহিলা পঞ্চায়েত প্রধানের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে পঞ্চায়েত পরিচালনা করা মহিলা প্রধান এখনও ব্যতিক্রম। তার পিছনে অনেক ক্ষেত্রে উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতা যেমন একটি কারণ, আবার এলাকা সম্পর্কে বিশদ ধারণা না থাকা বা নিজস্ব ভাবনা মনের কোণে চাপা দিয়ে স্থানীয় নেতার কথামতো চলার বাধ্যবাধকতাও কারণ হয়ে দাঁড়ায় বলে অভিযোগ।
বাঁকুড়ার পাত্রসায়র ব্লকের বাংলাডাঙা গ্রামের স্নাতকোত্তীর্ণ সরলা টুডুর ১৮ বছর আগে বিয়ে হয় ইঁদপুরের রঘুনাথপুর পঞ্চায়েতের রতনপুরে। স্বামী শীতল টুডুর সঙ্গে কৃষিকাজ ও টিউশন করে সংসার চলে যাচ্ছিল। শীতল তৃণমূলেরসভা-সমিতিতে গেলেও, সরলা রাজনীতির সাত-পাঁচে ছিলেন না। ২০১৮ সালে তৃণমূল নেতাদের অনুরোধে সরলা পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়ান। প্রধান পদ তফসিলি মহিলা সংরক্ষিত ছিল। ভোটে জিতেই প্রধান হন সরলা। তাঁর কথায়, ‘‘এলাকা ভাল না বুঝলেও, মানুষের জন্য কাজকরার সুযোগ পাব ভেবেছিলাম। সকালে রান্না সেরে সাইকেলে পঞ্চায়েতে যাই। স্বামীকেও অনেক সময় নিয়ে যাই। এখন মাঝেমধ্যে জমিতে কাজে গেলেও, টিউশন করার সময় থাকে না।’’
এলাকাবাসীর অনেকে এবং বিরোধীদের দাবি, সরলা শিক্ষিত হলেও, প্রধান হিসেবে তাঁর ‘স্বাধীনতা’ নেই। বিজেপির ইঁদপুরের নেতা তারকনাথ গোস্বামীর অভিযোগ, ‘‘সংরক্ষণের দোহাই দিয়ে ওঁকে চেয়ারে বসিয়ে পিছন থেকে দলের বড় নেতারা পঞ্চায়েতে ছড়ি ঘোরান। তৃণমূলের অনেক নেতা নিজেরা ঠিকাদার। নানা প্রকল্পের কাজ তাঁরাই করেন। সে সব তদারকের এক্তিয়ারও প্রধানের নেই। এলাকার দলের নেতাদের হাল পাল্টে গেলেও, সরলার দুঃখ ঘোচেনি।’’ স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছর বৃষ্টিতে মাটির বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়ে। এখন একটি অ্যাসবেস্টসের ছাউনির ঘর তৈরি করে থাকেন। সরকারি প্রকল্পে বাড়ির আবেদন করেছেন, তবে এখনও পাননি।
সরলা অবশ্য বলছেন, ‘‘নিজেরটা ভাবলে হবে? মানুষের জন্য কাজ করাও কি কম পাওয়া!’’ দলের নেতাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা তিনি মানতে চাননি। ইঁদপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি অসিত লায়েকেরও দাবি, ‘‘সরলা পঞ্চায়েতের কাজে দক্ষ। তাঁর কাজে কেউ হস্তক্ষেপ করেন না। সরকারি নিয়ম মেনে, ঠিক সময়ে তিনি বাড়ি পাবেন।’’
তবে মহিলা পরিচালিত পঞ্চায়েত যে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারে, বাঁকুড়ার তালড্যাংরার ফুলমতি পঞ্চায়েতের ২০০৮ সালে গঠিত পুরবোর্ড তার প্রমাণ বলে মনে করেন অনেকে। সে বার বামেরা ওই পঞ্চায়েতে জিতে সম্পূর্ণ মহিলা পরিচালিত বোর্ড গড়ে। তৎকালীন প্রধান অপর্ণা রায়, উপপ্রধান শিলাবতী নন্দী, সদস্য লক্ষ্মীরানি সরেনদের দাবি, ‘‘১২ জন সদস্যের বোর্ড ছিল। সবাই কম-বেশি শিক্ষিত। রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে, তৃণমূল নানা পঞ্চায়েতের কাজ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ তুললেও, আমাদের কাজে কোনও প্রশ্ন ওঠেনি।’’
সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্রের দাবি, ‘‘সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশ ও মহিলাদের সামনে এনে তাঁদের উন্নয়নের কাজে শামিল করা। ফুলমতি পঞ্চায়েতে সিপিএমের প্রধান-সহ মহিলা সদস্যেরা সুযোগ পেয়ে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান শাসক দল বহু মহিলা প্রধানকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেয় না।’’ কেন্দ্রের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী তথা বাঁকুড়ার বিজেপি সাংসদ সুভাষ সরকারের মতে, ‘‘মহিলাদের শুধু প্রধান করলেই হবে না, প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজটাও শিখিয়ে দিতে হবে। তা না হলে অনেকে নামেই প্রধান হয়ে থেকে যাবেন। মূল উদ্দেশ্য মাঠে মারা যাবে।’’
রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের মন্ত্রী তথা মানবাজারের তৃণমূল বিধায়ক সন্ধ্যারানি টুডুর যদিও দাবি, ‘‘পঞ্চায়েতের মহিলা প্রধানেরা সুন্দর ভাবে উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা কারও দ্বারা পরিচালিত হন, বিরোধীরা এমন অভিযোগ তুলে তাঁদের অপমান করছেন।’’ রাজ্যের খাদ্য প্রতিমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডিও মহিলা প্রধানদের উপরে দলের খবরদারির অভিযোগ উড়িয়ে দাবি করেন, ‘‘ধাপে-ধাপে অনেকেই কাজ শিখছেন। অনেকে খুব ভাল রপ্ত করেছেন, কেউ-কেউ হয়তো একটু পিছিয়ে রয়েছেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়ে বহু মহিলাই সমাজ গড়ার কাজে এগিয়ে আসছেন।’’ (শেষ)
(তথ্য সহায়তা: রথীন্দ্রনাথ মাহাতো)