সবুজ কেড়েছে কার্বনের গুঁড়ো

‘দূষণ’ শিল্পাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই বড়জোড়া শহরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে শব্দটা। সরকারি অফিসে অবস্থান, কারখানার দরজায় বিক্ষোভ... দূষণের থাবা থেকে মুক্ত করা যায়নি বড়জোড়াকে। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের সময় দামোদর নদের তীরে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার এই জনপদকে শিল্পাঞ্চলের তকমা দেওয়া হয়। একের পর এক শিল্প গড়ে ওঠে এই এলাকায়। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্পঞ্জ আয়রন ও ফেরোঅ্যালয়। এই কারখানাগুলি থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়ায় বলে বহু রাজ্যই এই শিল্পের জন্য দরজা বন্ধ করেছে।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:০০
Share:

দূষণ-গ্রাসে বড়জোড়া। আকাশ ঢেকেছে কারখানার কালো ধোঁয়ায়। ছবি: অভিজিৎ সিংহ

‘দূষণ’ শিল্পাঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই বড়জোড়া শহরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গিয়েছে শব্দটা। সরকারি অফিসে অবস্থান, কারখানার দরজায় বিক্ষোভ... দূষণের থাবা থেকে মুক্ত করা যায়নি বড়জোড়াকে।

Advertisement

রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের সময় দামোদর নদের তীরে অবস্থিত বাঁকুড়া জেলার এই জনপদকে শিল্পাঞ্চলের তকমা দেওয়া হয়। একের পর এক শিল্প গড়ে ওঠে এই এলাকায়। যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল স্পঞ্জ আয়রন ও ফেরোঅ্যালয়। এই কারখানাগুলি থেকে মারাত্মক দূষণ ছড়ায় বলে বহু রাজ্যই এই শিল্পের জন্য দরজা বন্ধ করেছে। কিন্তু বামেদের আনুকুল্যে একের পর এক স্পঞ্জ ও ফেরো কারখানা গড়ে উঠেছে বড়জোড়ায়। আর তা হয়েছে জনবসতিকে ঘিরেই।

দূষণের আঁচ পেয়েই সেই সময় এই সব কারখানা গড়ার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন বাসিন্দাদের একাংশ। আবার কর্মসংস্কৃতির মোহও ছিল অনেকের চোখেমুখে। কিন্তু কারখানা চালু হওয়ায় মাসখানেক পরেই সেই সব মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। সবুজ ধানের লতেলতে শিষে কালো কালো ধুলো কোথা থেকে এল? বাড়ির ছাদে, ঘরের মেঝেয় উড়ে আসতে শুরু করল কালো ধুলো। কয়েক বছর ঘুরতেই বাসিন্দারা বুঝলেন, শিল্পের নামে ভয়ঙ্কর দূষণের শিকার হয়েছেন তাঁরা। যন্ত্রনির্ভর ওই সব কারখানায় কর্মসংস্থানও যে বিরাট কিছু হয়েছে, তা নয়। এ দিকে কারখানায় জলের জোগান দিতে মাটির নীচে জলের ভাণ্ডারে টান পড়ায়, গৃহস্থের টিউবওয়েল, কুয়োর জলেরস্তরও অনেক নেমে গিয়েছে।

Advertisement

কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে একের পর এক জনশুনানিতে বাসিন্দাদের আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়েই এই সব কারখানা গড়ার অনুমতি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। তৎকালীন বিরোধীরা এ নিয়ে প্রতিবাদ, আন্দোলন করলেও বিশেষ আমল পায়নি। একে একে কারখানার চিমনি গড়ে উঠেছে। কারখানার চিমনি থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসা কালো ধোঁয়ায় ততদিনে ঢেকে গিয়েছে বড়জোড়ার আকাশ। এখন ঘরে ঘরে খোঁজ নিলে দেখা যায়, অনেকেই শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যায় ভুগছেন। পুকুর-খালের জলেও কার্বনের গুঁড়ো মিশেছে। তাই চর্মরোগও অনেক বেড়ে গিয়েছে। ফসলেও ক্ষতি হচ্ছে। কার্বন-মিশ্রিত ঘাস খেয়ে মারা যাচ্ছে গবাদি পশুও।

দীর্ঘ এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বড়জোড়াবাসীর চিকিৎসা করছেন সুখেন্দু লায়েক। তিনি জানান, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, বিভিন্ন প্রকার এলার্জি বেড়ে গিয়েছে। কমে গিয়েছে মানুষের কর্মক্ষমতা। এ রকম রোগীর সংখ্যা এই এলাকার প্রচুর। এই সমস্ত রোগের জন্য পরিবেশ দূষণকেই দায়ী করছেন তিনি। তাঁর কথায়, “এলাকার বায়ুতেই ছড়িয়ে গিয়েছে দূষণ। গাছের পাতা, পুকুরের জল, মানুষের বাড়িতেও দূষণের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও।”

পরিবহণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বড়জোড়ার বাসিন্দা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ এই কারখানাগুলোকে দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র চালাতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে কারখানাগুলিতে সেই যন্ত্র চালানো হয় না। আমার বাড়ির ছাদে, দেওয়ালে কালো ধোঁয়ার আস্তরণ পড়ে গিয়েছে। বাড়ির ভিতরের অবস্থাও তথৈবচ।” থানাপাড়ার বধূ রিঙ্কু ঘোষের অভিযোগ, তাঁর ১২ বছরের ছেলের সম্প্রতি শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। চনমনে স্বভাবের ছেলেটার হঠাৎ কেন এমন হল জানতে চাওয়ায় ডাক্তাররা দূষণকেই কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। সারদাপল্লির বাসিন্দা প্রাক্তন শিক্ষক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই রোগের শিকার। তাঁর ছেলে অভয় বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই ঘটনার জন্য স্পঞ্জ-ফেরোর দূষণকেই দুষছেন।

দূষণ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করে যাওয়া বড়জোড়ার প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান তৃণমূলের অলোক মুখোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, শুধু বিষাক্ত ধোঁয়াই তো নয়, মানুষের জীবনধারণের অতিপ্রয়োজনীয় জিনিস জলও ওইসব কারখানা কেড়ে নিয়েছে। তাঁর অভিযোগ, “বামফ্রন্ট সরকার জলের বন্দোবস্ত না করে ওই সব কারখানা নিয়ে এসেছে। পঞ্চায়েত সমিতি থেকেও পর্যাপ্ত পরিমাণে জল সরবরাহ করতে পারেনি কারখানাগুলিতে। ফলে উৎপাদন চালাতে অবৈধ ভাবে মাটির তলা থেকেও জল তোলা শুরু করে কারখানাগুলি। জলের স্তর কমে গিয়ে প্রতি বছর বড়জোড়ায় জলের জন্য হাহাকার পড়ে যায়।”

স্পঞ্জ ও ফেরো অ্যালয় কারখানার মালিকরা অবশ্য এই সব অভিযোগ মানতে রাজি নন। তাঁদের দাবি, নিয়ম ভেঙে কিছু করা হয় না। দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্রও ব্যবহার করা হয়। জল চুরির অভিযোগও তাঁরা মানতে চাননি। তাঁদের পাল্টা অভিযোগ, কিছু ব্যক্তি অন্যরকম সুবিধা নেওয়ার জন্য চাপে রাখতেই মিথ্যা অভিযোগ তোলেন। তবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের একাধিক আধিকারিক জানিয়েছেন, তাঁরা অভিজ্ঞতায় দেখেছেন কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র রাখা হলেও কর্তৃপক্ষ তা অধিকাংশ সময় চালায় না। হঠাৎ-পরিদর্শনে গিয়ে তাঁরা এই ঘটনা বারবার দেখেছেন।

সে ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? দফতরের এক কর্তা বলেন, “এলাকায় আমাদের নজর রয়েছে। বেশিমাত্রায় ধোঁয়া বেরনোর অভিযোগ পেলেই আমরা কারখানায় হানা দিই। এ ভাবে গত কয়েক মাসেই বেশ কিছু কারখানায় নিয়ম ভাঙ্গার ঘটনা ধরা পড়েছে। আমরা কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছি। জরিমানা করা থেকে নানারকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”

এমনটাই বছরের পর বছর দেখতে অভ্যস্ত বড়জোড়াবাসী। বড়জোড়ার রাজনীতিও গত এক দশক ধরে ‘শিল্পজনিত দূষণ’ বিষয়কে কেন্দ্র করেই চলছে। ভোটের ময়দানেও দূষণ মুক্ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছে। কিন্তু রাজ্যের ক্ষমতা রদবদলের পরেও দূষণের ছবিটা বদলায়নি। যেমন বড়জোড়া কেন্দ্রের বিধায়ক তৃণমূলের আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ক্ষোভ, “পরিবেশ ধ্বংসকারী এই স্পঞ্জ-ফেরো কারখানাগুলির মাধ্যমে বামফ্রন্ট সরকার বড়জোড়াবাসীকে ‘দূষণ’ উপহার দিয়ে গিয়েছে।” আপনারা কী করেছেন? তাঁর দাবি, “বহুবার প্রশাসনিক বৈঠকে কারখানা কর্তৃপক্ষদের দূষণ নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” দূষণ কি তবে বন্ধ? এ বার বিধায়কের স্বীকারোক্তি, “না, এখনও বন্ধ করা যায়নি। তবে আগের থেকে দূষণ কমেছে।”

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য তথা বড়জোড়ার বাসিন্দা সুজয় চৌধুরী আবার অন্য দাবি করছেন। তাঁর দাবি, “বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে এই সব কারখানাগুলির দূষণের উপরে কড়া নজর রাখা হত। নিয়মিত দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ থেকে নজরদারি চালানো হত। তাই তখন দূষণের মাত্রা কম ছিল। কিন্তু তৃণমূল সরকার এ সবে নজর দেয় না বলে সম্প্রতি দূষণ বেড়েছে।”

দূষণের জন্য কে দায়ী, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যতই বিতর্ক উঠুক, বড়জোড়ার আমজনতা তা নিয়ে মাথা ঘামাতে নারাজ। তাঁদের একটাই দাবি, ‘পরিবেশ হোক দূষণ মুক্ত’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement