ক্ষোভে ফুটছেন। বৃহস্পতিবার বাড়িতে দুধকুমার। ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।
দু’দিন আগেই দলের রাজ্য পর্যবেক্ষকের কাছে তিনি ছিলেন ‘শের-দিল’ (সিংহ-হৃদয়) কর্মকর্তা। তাঁর অভিজ্ঞতা দলের সম্পদ বলে সিউড়িতে প্রকাশ্য মঞ্চেই ঘোষণা করেছিলেন নতুন রাজ্য সভাপতিও।
সম্ভাবনা জাগিয়েও সেই তিনি-ই ঠাঁই পাননি রাজ্য সংগঠনে। এমনকী, রাজ্য নেতৃত্ব বদলের পরে জেলায় সংগঠনের কোনও পদও তাঁর জোটেনি। ক্ষোভে-দুঃখে শেষমেশ তৃণমূলের ‘সাসপেন্ড’ হওয়া সিউড়ির বিধায়ক স্বপন ঘোষের পথেই রাজনৈতিক সন্ন্যাসের কথা ঘোষণা করলেন বীরভূমের দাপুটে বিজেপি নেতা দুধকুমার মণ্ডল। বুধবার রাতে তাঁর ওই ঘোষণার পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই নানা জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে। বাড়ছে গুঞ্জন। দুধকুমার কি তা হলে তৃণমূলে যাবেন? তিনি নিজে অবশ্য সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। আপাতত স্বপনবাবুর একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে যোগ দিয়ে সমাজসেবাতেই তিনি মন দিতে চান।
১৯৮২ সাল থেকে সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত দুধকুমার ১৯৯১ সালে বিজেপি-তে যোগ দেন। দু’বার স্থানীয় ময়ূরেশ্বর পঞ্চায়েতের প্রধান এবং দু’বার ওই এলাকা থেকে পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যও হন। দলের হয়ে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করেন বিধানসভায়। পরবর্তী কালে রাজ্যে নেতৃত্ব তাঁকে বীরভূমের জেলা সভাপতি পদে বেছে নেয়। গত লোকসভা ভোটে তাঁর নেতৃত্বে বীরভূমে ভাল ফল করে বিজেপি। আসন না পেলেও আগের তুলনায় ভোট শতাংশ বহু গুণ বাড়িয়ে নেয়। ফলাফলের হিসেবে জেলার ছ’টি পুরসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে শাসকদল তৃণমূলকে পিছনে ফেলে এগিয়েও যায়। শুধু শহরাঞ্চলই নয়, কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এই দুধকুমারের দাপটেই পাড়ুই, মাখড়া-সহ বোলপুর ও সিউড়ি মহকুমার বড় অংশের গ্রামীণ এলাকায় মজবুত সংগঠন গড়ে তোলে বিজেপি। জেলা রাজনীতির গতিপ্রকৃতির নিয়মিত পর্যবেক্ষকদের একটা বড় অংশের মতে, সে সময় তাঁকে তৃণমূলের দাপুটে জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলের সঙ্গে সমানে টক্কর দিতেও দেখা যায়। তাঁরই ঢঙে রামপুরহাটের দলীয় সভায় প্রকাশ্যে তৃণমূল কর্মীদের হাত কেটে নেওয়ার হুমকিও তাঁকে দিতে দেখা যায়।
রাতারাতি জেলার গণ্ডি ছাড়িয়ে রাজ্য রাজনীতিতেও আলোচিত হতে থাকে বীরভূমের এই বিজেপি নেতার নাম। দুধকুমারের এক অনুগামীর দাবি, ‘‘ক্রমবর্ধমান এই জনপ্রিয়তা রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে দুধদার সঙ্ঘাতকে অনিবার্য করে তোলে। তা ছাড়া দুধদার হাত কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়ার মতো কিছু মন্তব্যেও নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ হয়। আর তারই ফলে জেলা এবং রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ বিশেষ করে তৎকালীন রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের সঙ্গে তাঁর তীব্র সঙ্ঘাত শুরু হয়।’’ আর তারই জেরে গত পুরভোটে প্রার্থী তালিকা তৈরিতে গুরুত্ব কমে দুধকুমারের। তাঁকে অন্ধকারে রেখে টাকার বিনিময়ে টিকিট বিলি করা হয়েছে বলে প্রকাশ্যে রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন দুধকুমারও। জেলা সভাপতির পদ থেকে ইস্তফাও দিয়ে দেন। সেই সময় তাকে পদে ফেরানোর জন্য নানা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন দুধকুমারের অনুগামীরা। কিন্তু, রাজ্য নেতৃত্ব এই সুযোগ ছাড়েননি। দুধকুমার বিরোধী বলে পরিচিত ময়ূরেশ্বর এলাকারই অর্জুন সাহাকে প্রথমে জেলা আহ্বায়কের পদে এনে কিছু দিনের মধ্যে জেলা সভাপতিও করে দেওয়া হয়। তার পর থেকেই দলে আরও কোণঠাঁসা হয়ে পড়েন দুধকুমার এবং তাঁর অনুগামীরা।
দুধকুমার গোষ্ঠীর ভাবনা ছিল, রাজ্য সভাপতির পরিবর্তন হলে হয়তো ছবিটা পাল্টাবে। সঙ্ঘ নেতা দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতির দায়িত্বে আসার পরে আশা দেখেছিলেন খোদ দুধকুমারও। গত ১৮ ডিসেম্বর সিউড়িতে রাজ্য পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, দিলীপবাবু এবং রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে দলের আইন অমান্য কর্মসূচিতে অর্জুনের বদলে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায় দুধকুমারকেই। বিজয়বর্গীয়, দিলীপ— দলের দুই শীর্ষ নেতাকে তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখে শুরু হয় নয়া জল্পনাও। বিজেপি কি তা হলে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ দুধকুমারের হাতেই জেলার দায়িত্ব দিতে চলেছে? সে জল্পনায় জল ঢেলে তার কয়েক দিনের মধ্যেই কলকাতা থেকে জেলা সভাপতি হিসাবে ঘোষণা করা হয় দুধকুমার বিরোধী বলে পরিচিত রামকৃষ্ণ রায়ের নাম। এমনকী, দুধকুমারকে ঠাঁই দেওয়া হয়নি নতুন জেলা কমিটিতেও। সে সময় দুধকুমারকে রাজ্য কমিটিতে নেওয়ার কথা অবশ্য শোনা গিয়েছিল রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের মুখে। এমনকী রাজ্য সহ-সভাপতি হিসাবে দুধকুমারের নাম ভাবা হচ্ছে বলে অনুগামীদের মধ্যে জল্পনাও ছিল।
বুধবার সব হিসেব ওলোটপালট হয়ে যায়। কোথাও ঠাঁই না পেয়ে রাজনৈতিক সন্ন্যাসের কথা ঘোষণা করে দেন ক্ষুব্ধ দুধকুমার। আর তার পরেই শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। দুধকুমার নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলে বিধানসভা ভোটের মুখে আখরে দলেরই ক্ষতি হবে, মানছেন রাজ্য নেতৃত্বের একাংশ। অস্বীকার করছেন না দলের বর্তমান জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণবাবুও। তিনি বলছেন, ‘‘একজন সমর্থকও দল ছেড়ে গেলে ক্ষতি হয়। সেখানে দুধকুমারবাবু দল ছেড়ে গেলে ক্ষতি তো হবেই। সংবাদমাধ্যমেই তাঁর রাজনৈতিক সন্ন্যাস নেওয়ার ঘোষণা শুনেছি। তবে, এখনও কথা বলে উঠতে পারিনি।’’
অথচ এ দিন সকাল ৯টা নাগাদ কোটাসুরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল ফোনের পর ফোনে ব্যতিব্যস্ত দুধকুমার। সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ হাইকোর্টের এক আইনজীবীকে ফোনে বলছিলেন, ‘‘আর দলে থাকা গেল না। দল ক্ষমতা দখলের জন্য আমাকে ব্যবহার করে কিষেণজির দশা করবে, তা আমি মানতে পারছি না।’’ পরে ওই কথার ব্যাখ্যাও দেন দুধকুমার। তাঁর দাবি, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার জন্য কিষেণজিকে ব্যবহার করেছিল। তার পর তাঁর কী দশা হয়েছে, সবাই জানেন। ‘‘দল আমাকেও কোণঠাসা করে তা-ই করতে চাইছে। রাজ্য সভাপতি বদল হওয়ার পরেও অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দিলীপ ঘোষ সঙ্ঘ পরিবারের সুবাদে আমারও ঘনিষ্ঠ। কিন্তু, তিনিও রাহুল সিংহের অঙ্গুলিহেলনেই চলছেন বলে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে মহামূর্খ ছাড়া কেউ-ই ২০১৬ সালে দল ক্ষমতায় আসবে বলে বিশ্বাস করবে না। ক্ষমতায় আসার জন্য যে মুখকে খাড়া করতে হয়, রাজ্য বিজেপি-তে সেই মুখ একটাও নেই,’’— দাবি অভিমানী দুধকুমারের।
অনুব্রত কিংবা সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা, দুধকুমারের এই অবস্থান নিয়ে দু’জনেই মন্তব্যে নারাজ। তবে, দুধকুমারের এই হাল নিয়ে মুখ খুলেছেন স্বপনবাবু। শীঘ্রই শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নিয়ে কাজ করার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা খুলতে চলেছেন তিনি। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তাতে সামিল হচ্ছেন দুধকুমারও। স্বপনবাবু বলছেন, ‘‘দল নয়, আমার ক্ষোভ ছিল সরকারের ভূমিকা নিয়ে। কিন্তু, দুধকুমারকে নিয়ে ওর দল যে ব্যবহার করছে, ক্ষোভ হওয়াটা স্বাভাবিক। সেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়ে আগেই ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি একসঙ্গে কাজ করতে রাজিও হয়েছেন।’’
এখন বাড়িতে থাকা শিশুদের স্কুল এবং স্বপনবাবুর সংস্থায় কাজ করেই দিন কাটাতে চান দুধকুমার।