ফাইল চিত্র।
সাধারণ মানুষের থেকে অভিযোগটা আগেও উঠেছে। বুধবার সন্ধ্যায় খোদ বিডিও যখন বুকে যন্ত্রণা নিয়ে বিষ্ণুপুর সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে এলেন, তখন সেখানে ডাক্তারের দেখা নেই। তার পরেই নড়াচড়া শুরু হয়ে যায়। শোকজ় করা হয় এক চিকিৎসকে। শহরের এক বাসিন্দা বলছিলেন, ‘‘নগর যখন পুড়ছিল, তখন কারও নজর ছিল না। প্রশাসনের উপরে আঁচ পড়তেই এখন সবাই তৎপর।’’
বুধবার সন্ধ্যায় বিডিও (বিষ্ণুপুর) স্নেহাশিস দত্ত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে বেশ কিছুক্ষণ বিনা চিকিৎসায় পড়ে থাকেন। অভিযোগ, সেই সময়ে ওই বিভাগে কোনও ডাক্তার ছিলেন না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসেন বিষ্ণুপুর স্বাস্থ্য জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রমেন্দ্রনাথ প্রামাণিক। তারপরেই জরুরি বিভাগে দেখা যায় ডজন খানেক চিকিৎসককে। রাতেই এক ডাক্তারকে শোকজ়ের সিদ্ধান্ত নেন হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার তড়িৎকান্তি পাল।
বছর খানেক আগে এই হাসপাতাল পরিদর্শনে এসেছিলেন বাঁকুড়ার জেলাশাসক উমাশঙ্কর এস। তখনও বিস্তর বেনিয়ম সামনে আসে। মেল মেডিসিন ওয়ার্ডে ঢোকার সময়ে মত্ত সাফাইকর্মী জেলাশাসককে ‘সব ঠিক আছে’ বোঝাতে গিয়ে শ্রীঘরে যান। বিকেল ৪টে নাগাদ ব্লাড ব্যাঙ্কে ঢুকে ডিএম দেখেন, শুধু এক জন মেডিক্যাল অফিসার রয়েছেন। কোনও কর্মী নেই। ল্যাব টেকনিশিয়ানও নেই।
‘‘এ ভাবে হাসপাতাল চলতে পারে না। দ্রুত ব্যবস্থা নিন।’’— সিএমওএইচকে এ কথা বলে সে বার হাসপাতাল ছেড়েছিলেন জেলাশাসক। কিন্তু হরেদরে যে একই ভাবে দিন চলেছে, সে কথা বিডিও অসুস্থ হওয়ায় আবার সামনে এল বলে মনে করেছেন স্বাস্থ্য জেলার অনেক বাসিন্দাই। রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য দিব্যেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘অনেক চিকিৎসকই চেম্বার নিয়ে এতটা ব্যস্ত থাকেন, যে হাসপাতালের কথা ভুলেই যান। রোস্টার মেনে চললে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়।’’
প্রতি দফায় জরুরি বিভাগে তিন জন চিকিৎসকের থাকার কথা। বুধবার সন্ধ্যা সওয়া ৭টা নাগাদ হাসপাতালে পৌঁছন বিডিও। রোস্টার অনুযায়ী তখন জরুরি বিভাগের টেবিলে থাকার কথা যে চিকিৎসকের, তিনি প্রশিক্ষণের জন্য বাইরে রয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত সুপার বলেন, “তাঁর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে অন্য এক চিকিৎসককে। কিন্তু সেই চিকিৎসক দায়িত্ব পাওয়ার খবরই পাননি বলে জানতে পারলাম।’’ রোস্টার এবং সেই সংক্রান্ত সমন্বয়ের গলদ গোড়ার এই জায়গা থেকেই বলে মনে করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
ওই সময়ে জরুরি বিভাগের ওয়ার্ডে থাকার কথা ছিল দু’জন চিকিৎসকের। তাঁদের মধ্যে এক জন ছুটিতে রয়েছেন। অন্য জন ছিলেন না। তাঁদের আগের দফায় যে চিকিৎসক ছিলেন, শোকজ় করা হয়েছে তাঁকে। রাজকুমার মণ্ডল নামে সেই চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘বুধবার দুপুর আড়াইটে থেকে সন্ধ্যা সওয়া ৬টা পর্যন্ত জরুরি বিভাগে আমার থাকার কথা ছিল। তার পরেও ২০ মিনিট রোগী দেখেছি।’’ তাঁর দাবি, তার পরে যে চিকিৎসকের থাকার কথা তাঁকে চার বার ফোন করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত ‘কল বুক’-এ নোট দিয়ে ডেকে পাঠিয়ে জরুরি বিভাগ ছাড়েন।
রাজকুমারবাবুর দাবি, ‘‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে কেউ এ রকম করছে। আমি শোকজ়ের উপযুক্ত জবাব দিয়েছি।” তবে ভারপ্রাপ্ত সুপারের বক্তব্য, জরুরি বিভাগ খালি রেখে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তাঁকে খবরটা দিয়ে যেতে পারতেন ওই চিকিৎসক। তিনি বলেন, ‘‘শোকজ়ের জবাব আমি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
এ দিকে, রহস্য আরও বেড়েছে ‘কল বুক’ থেকে পাতা উধাও হওয়ায়। ডাক্তার সন্নিগ্রাহীকে ডাক্তার মণ্ডল যে নোট লিখে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সেই পাতা বৃহস্পতিবার তন্নতন্ন করে খুঁজেও পাননি অন্য চিকিৎসক এবং নার্সেরা। এ দিকে, ভারপ্রাপ্ত সুপার এবং খোদ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সেই পাতা দেখেছিলেন বলে জানাচ্ছেন। ‘তথ্য লোপাটের’ বিষয়ে তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক।
এখন রোস্টারের সর্ষের মধ্যে কোথায় গড়বড়, সেটাই বের করতে চাইছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তড়িৎকান্তিবাবু বলেন, ‘‘রোস্টারের তোয়াক্কা না করে কোনও কোনও চিকিৎসক নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে হাসপাতালে সময় দেন। এমনটা কোনও ভাবেই হওয়ার কথা নয়।’’ মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক রমেন্দ্রনাথবাবু বলেন, ‘‘তদন্তের রিপোর্ট ও শোকজ়ের উত্তর আমি স্বাস্থ্য দফতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাঁদের নির্দেশ মতই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি নিয়ে বার বার বিভিন্ন স্তরে অভিযোগ আমার কাছে জমা পড়ছে। রোস্টার স্বচ্ছ ভাবে মানা না হলে এই সমস্যার সমাধান হবে না।’’