পরিষেবা নিয়ে ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। বান্দোয়ান বাসস্ট্যান্ডের ছবি তুলেছেন প্রদীপ মাহাতো।
ঘুরে দাঁড়াতে চাইলেও কি এগোতে পেরেছে বান্দোয়ান? না কি জঙ্গলমহলের উন্নয়নকে পাখির চোখ করা রাজ্য সরকারের ছিঁটে ফোঁটা এসে পড়ছে এখানে, আর সিংহভাগ চলে যাচ্ছে অন্যত্র?
বাসিন্দাদের দাবি, এক পা-ও এগোয়নি বান্দোয়ান। ছোটখাটো কিছু কাজ ছাড়া বড় কোনও পরিকাঠামো গড়া হয়নি। তাঁরা জেলার অন্য এলাকার সঙ্গে বান্দোয়ানে সমহারে বিকাশ হয়নি বলে অভিযোগ তুলেছেন। তাঁদের বঞ্চনার তালিকায়— যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, পরিবহণ রয়েছে।
চার বছর হল রাজ্যে সরকার বদলে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। এতদিন বান্দোয়ানের অনুন্নয়নের জন্য তৃণমূল নেতারা বাম সরকারকে বিঁধত। কিন্তু নতুন করে বিধানসভা ভোট আসার আগে এখন বাসিন্দাদের অনেকের মুখেই সেই ‘উপেক্ষা’র অভিযোগ তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধেও শোনা যাচ্ছে। সেই সুর ধরে সিপিএম নেতাদের অভিযোগ, ‘‘আমরা তো এলাকায় উন্নয়নের চাকাটা গড়িয়েছিলাম। কিন্তু গত চার বছরে তৃণমূল সরকার তো সেই চাকাটাকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
বান্দোয়ানের বাসিন্দা বিশিষ্ট সাঁওতালি সাহিত্যিক মহাদেব হাঁসদা বলেন, ‘‘উন্নয়ন একটি প্রবহমান স্রোত। জেলার মধ্যে সব থেকে বেশি আদিবাসী এখানে বাস করেন। ক্ষমতায় যে সরকারই থাকুক না কেন আদিবাসীদের উন্নয়নে কিন্তু এখানে গতি নেই।’’ তাঁর অভিজ্ঞতা, জীবনযাত্রার মানে কয়েক দশকে এখানে বিশেষ পরিবর্তন আসেনি। আদিবাসীদের উন্নয়নের জন্য সরকারের পরিকল্পনা অনেক আছে, কিন্তু সেগুলি তৃণমূল স্তরে আর প্রয়োগ হয় না। যে এলাকার সাথে বাইরের যোগাযোগ বেশি থাকবে, সেই এলাকার উন্নয়ন তত বেশি তরান্বিত হবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বান্দোয়ান পিছিয়েই রয়েছে।
এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মধুসূদন অগ্রবাল, কৈলাস অগ্রবাল, প্রশান্ত মোদকরা জানান, এখানে রেল যোগাযোগের দাবি আজও পূরণ হয়নি। সদর পুরুলিয়ার সাথে যোগাযোগের ভরসা বলতে গুটিকয় বেসরকারি বাস। তাঁদের অভিযোগ, ‘‘শাসকদল ক্ষমতায় আসার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জঙ্গলমহল থেকে রাজধানী পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা সুগম করা হবে। তা বাস্তবায়িত হলে বান্দোয়ানের শ্রী আরও ফিরত।’’ স্থানীয় বাসিন্দা সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, অজয় দত্তদের অভিজ্ঞতা, বাসে বান্দোয়ান থেকে ভায়া বরাবাজার হয়ে পুরুলিয়া পৌঁছতে তাঁদের প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ফিরে আসতেও আরও তিন ঘণ্টা। গাড়ির সংখ্যা কম থাকায় পুরুলিয়া শহরে সব কাজ শেষ না হলেও তড়িঘড়ি তাঁদের ফিরে আসতে হয়। বাকি কাজ সারতে আবার অন্যদিন সেই ছয় ঘণ্টার বাসযাত্রার ভোগান্তি সহ্য করে পুরুলিয়া যাতায়াত করতে হয়। আর সরকার অফিসে কাজ নিয়ে গেলে আধিকারিক বা কর্মীর দেখা পেতে কতবার যে যাতায়াত করতে হয় তার ঠিক নেই।
স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েও বাসিন্দাদের অভিযোগ বিস্তর। বান্দোয়ানের বাসিন্দা দিলীপ মাহাতো, বংশী মাহাতোদের অভিযোগ, সামান্য অসুখেও ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা মেলে না। অন্যত্র স্থানান্তর করে দেওয়া হয়। এই ব্লকে তিনটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে— চিরুডি, লতাপাড়া ও গুরুড়। শুধু চিরুডিতে অন্তর্বিভাগ রয়েছে। বাকি দু’টি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সকাল বেলায় দু’-তিন ঘণ্টার বেশি চিকিৎসকের দেখা মেলে না। ফলে মামুলি রোগ হলেও বাসিন্দাদের ভরসা সেই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু সেখানে চিকিৎসা মিলবে কি না অনেক সময় তার নিশ্চয়তাও নেই। বাসিন্দাদের দাবি, প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের কথা ভেবে জন্য এই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিকাঠামোর মানোন্নয়ন ঘটালে তাঁদের হুট করতেই পুরুলিয়া সদর অথবা টাটার হাসপাতালে দৌড়তে হতো না।
বান্দোয়ান বিধানসভা কেন্দ্র দীর্ঘদিন ধরে বামেদের। কী করেছেন সিপিএম বিধায়ক সুশান্ত বেসরা? তাঁর দাবি, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে বান্দোয়ানের কিছু উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু এই সরকার রাজনৈতিক রঙের বিচার করে বান্দোয়ানকে বঞ্চিত করছে। বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্র কার্যত একজন চিকিৎসক চালাচ্ছেন। বিধানসভায় স্বাস্থ্য স্থায়ী সমিতির বৈঠকে বান্দোয়ান ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেহাল অবস্থার কথা জানিয়েছি। সব সময়ের জন্য অন্তত আরও দু’জন চিকিৎসক চেয়েছি। আমার তদ্বিরে কাজ হয়নি। তাই এখানকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কার্যত মুখ থবড়ে পড়েছে।’’
পানীয় জলেরও সমস্যা রয়েছে। তিন দশক আগে বড়বাঁধ লাগোয়া জমিতে সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে জল তোলা হতো। বাজার এলাকার অল্প কয়েকটি জায়গা ওই জল সরবরাহ করা হতো। এক দশক আগে বান্দোয়ানের সুপুডি গ্রামে পারগেলা জলাধার থেকে দ্বিতীয় জল প্রকল্প চালু হয়। অভিযোগ গ্রীষ্মে ওই দুই প্রকল্প থেকে জল মেলে না। ব্লক অফিস এলাকার বাসিন্দা রেবতী মাহাতো, শকুন্তলা মাহাতো বলেন, ‘‘অন্যত্র ব্লক সদর ছাড়িয়ে এখন গ্রামে গ্রামেও পাইপলাইনের জল পৌঁছে গিয়েছে। কিন্তু বান্দোয়ানে ব্লক সদরে থেকেও সারা বছর জল পাই না।’’
খানাখন্দে ভরে যাওয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে দৈনিক বাজারের বেহাল দশা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের। খেলার উপযোগী মাঠেরও অভাব রয়েছে এখানে। পঞ্চায়েত সমিতি তাদের মাঠ সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল। অসমাপ্ত গ্যালারি পড়ে রয়েছে। বান্দোয়ানের বিডিও মধুসূদন মণ্ডল অবশ্য নিকাশি নালার জল ঢুকে মাঠ নষ্টের কথা মানেননি। তিনি বলেন, ‘‘অনেক কিছুই আমার নাগালের বাইরে। তবে সবাইকে নিয়ে সাধ্যমতো উন্নয়নের কাজ চলছে। ’’