বিদ্যুৎ প্রকল্পের মূল গেটের সামনে বিক্ষোভ।—নিজস্ব চিত্র।
কাজের দাবিতে ডিভিসি-র তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল গেটের সামনে বিক্ষোভ-অবস্থান করছিলেন জমিহারারা। তাঁদের হঠাতে নির্বিচারে লাঠি চালানোর অভিযোগ উঠল কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনীর (সিআইএসএফ) বিরুদ্ধে। লাঠির আঘাতে মাথা ফেটেছে জমিহারা কমিটির সহ-সভাপতির। হাত ভেঙেছে আর সদস্যের।
বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরের ওই ঘটনায় ডিভিসি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জেলা প্রশাসন এবং শাসকদল তৃণমূল। আহত ওই দু’জন রঘুনাথপুর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তবে, দু’জন ছাড়াও লাঠির ঘায়ে তাদের সভাপতি চিন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ জনা পঁচিশ সদস্য অল্পবিস্তর চোট পেয়েছেন বলে দাবি জমিহারা কমিটির। আহতদের মধ্যে তিন জন মহিলা। প্রাথমিক চিকিৎসার পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
ডিভিসি কর্তৃপক্ষ অবশ্য লাঠি চালানোর দায় পুলিশের উপরে চাপিয়েছেন। প্রকল্পের চিফ ইঞ্জিনিয়ার হিরন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, জমিহারা কমিটির সদস্যরা বিক্ষোভ দেখানোর সময়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত রাজ্য পুলিশের উপরে পাথর ছুড়েছিলেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশই লাঠি চালিয়ে তাঁদের সরিয়ে দিয়েছে। যদিও পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার রুপেশ কুমার বলেন, “রঘুনাথপুরে ডিভিসির প্রকল্পে রাজ্য পুলিশ কোনও ভাবেই লাঠি চালায়নি। ওখানে কী ঘটেছিল, তা তদন্ত করতে বলা হয়েছে রঘুনাথপুরের এসডিপিও-কে।”
রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র নির্মীমাণ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজের দাবিতে জমিহারাদের অবস্থান-বিক্ষোভ নতুন ঘটনা নয়। সামান্য ঘটনাতেও প্রকল্পের মূল গেট আটকে বিক্ষোভ এর আগেও হয়েছে বহুবার। অনেক ক্ষেত্রে বিক্ষোভ ঘোরালো আকার নিয়েছে। প্রতি ক্ষেত্রেই পুলিশ-প্রশাসন গিয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যা মিটিয়েছে। কিন্তু এ বার তার ব্যতিক্রম ঘটল। এই প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার মুখে। কাজ গোটাচ্ছে ওই পর্যায়ের বিভিন্ন কাজের বরাতপ্রাপ্ত বেসরকারি ঠিকা সংস্থাগুলি। ফলে কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকেরা। বাদ যাননি স্থানীয় জমিহারারাও। এই অবস্থায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কিছু কাজ সবে শুরু হয়েছে। জমিহারারা পরিবারগুলি এখন সেই কাজে তাদের সদস্যদের নেওয়ার দাবি তুলেছে। কমিটির সম্পাদক দেবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, দ্বিতীয় পর্যায়ে বয়লার ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু করেছে একটি সংস্থা। কিন্তু, জমিহারাদের বদলে বাইরে থেকে শ্রমিক আনা হচ্ছে।
এই নিয়েই এলাকায় উত্তেজনা। বুধবারও প্রকল্পের মধ্যে ঢুকে জমিহারা কমিটি ওই সংস্থাটির কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। বৃহস্পতিবারও জমিহারাদের কাজে নেওয়ার দাবিতে ঘুটিতোড়া এলাকায়, প্রকল্পের মূল গেটের সামনে সকাল ন’টা থেকে অবস্থান বিক্ষোভ শুরু করে এসইউসি প্রভাবিত আরটিপিএস ল্যান্ড লুজারস অ্যাসোসিয়শন। মহিলা সহ শতাধিক জমিহারা সামিল হয়েছিলেন অবস্থানে। প্রত্যক্ষদর্শীরী জানাচ্ছেন, সেই সময়ে প্রকল্পে ঢুকতে গিয়ে আটকে পড়ে সিআইএসএফের এক পদস্থ কর্তার গাড়ি। ওই আধিকারিক গাড়ি থেকে নেমেই ডেকে নেন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা সিআইএসএফ জওয়ানদের। অভিযোগ, কর্তার নির্দেশ বিনা প্ররোচনায় জওয়ানেরা বিক্ষোভকারীদের উপরে লাঠি চালান। ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা সাধারণ মানুষও রেহাই পাননি। কমিটির দাবি, লাঠির আঘাতে মাথা ফাটে কমিটির সহ-সভাপতি হরি টুডুর। হাত ভাঙে সদস্য দেবানন্দ বারুইয়ের। আহত হন ওই প্রকল্পে বেসরকারি ঠিকাসংস্থার এক কর্মীও।
দেবজিৎবাবু বলেন, “গত এক বছর ধরে প্রশাসন এবং ডিভিসি কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে বিভিন্ন আলোচনায় স্থির হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে জমিহারাদের। কিন্তু ওই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সিদ্ধান্ত না মেনে বাইরে থেকে শ্রমিক এনে কম মজুরিতে কাজ করাচ্ছিল। বুধবার আমরা জমিহারাদের কাজে নেওয়ার দাবি জানিয়ে আপাতত কাজ বন্ধ করার জন্য ডিভিসি-র কর্তাদের বলেছিলাম। কিন্তু এ দিন ফের বাইরের শ্রমিকদের দিয়ে কাজ শুরু হওয়ায় বাধ্য হয়ে আমরা প্রকল্পের বাইরে অবস্থানে বসি।” ডিভিসি কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, বাইরে থেকে শ্রমিক আনার অভিযোগ ঠিক নয়। অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে স্থানীয় ও জমিহারারাই কাজ করছেন।
লাঠির ঘায়ে আহতেরা। বৃহস্পতিবার রঘুনাথপুর মহকুমা হাসপাতালে।
জমিহারাদের উপরে লাঠি চালানোর খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে যান রঘুনাথপুরের এসডিপিও পিনাকী দত্ত, থানার সিআই সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রঘুনাথপুর ও নিতুড়িয়া থানার ওসি। কিছু পরে পৌঁছন রঘুনাথপুর মহকুমা প্রশাসনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অজয় সেনগুপ্ত। তাঁর বক্তব্য, “এত দিন ধরে প্রশাসন এই প্রকল্পের যে কোনও সমস্যাই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে এসেছে। এ দিন এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, যাতে লাঠি চালিয়ে অবস্থান তুলে দিতে হবে।” তাঁর মতে, সিআইএসএফ যদি বাধা পেয়েই থাকে, তা হলে তারা রাজ্য পুলিশের সাহায্য চাইতে পারত। ঘটনায় ক্ষুব্ধ শাসকদলও। রঘুনাথপুরের তৃণমূল বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউরি বলেন, “আগে প্রশাসনিক স্তরে বৈঠকে প্রকল্পে জমিহারারাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। ফলে জমিহারারা ন্যায্য দাবিতেই অবস্থানে বসেছিলেন। তাঁদের উপরে লাঠি চালানোর ঘটনা নিন্দনীয়। এবং এই ঘটনায় ডিভিসি কর্তৃপক্ষ তাঁদের দায় এড়াতে পারেন না।”
জমিহারাদের উপরে লাঠি চালানোর ঘটনা এলাকার পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলবে বলে আশঙ্কা রয়েছে প্রশাসনেরই অন্দরে। এ দিন বিকেলের কমিটির সভাপতি রঘুনাথপুর থানায় সিআইএসএফের ওই পদস্থ কর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগও দায়ের করেছেন।