হুড়ার ব্যাঙ্কে লাইনে বয়স্কেরা। —নিজস্ব চিত্র।
মাসের দ্বিতীয় দিনেও হয়রানির ছবিটায় বিশেষ বদল দেখা গেল না দুই জেলায়। এটিএম-এর ঝাঁপ বন্ধ। ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইন, কিন্তু সেখানেও টাকা নেই। অবশেষে বেলা করে কয়েকটা গোলাপী টাকা এল হাতে। সব মিলিয়ে, ভোগান্তির ছবিটাই দিন দিন থিতু হচ্ছে জনজীবনে।
শুক্রবার পুরুলিয়া শহর এবং শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় টাকা তুলতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন গ্রাহকেরা। মুর্শিদাবাদের ওমরপুরের বাসিন্দা আবু তাহের সম্প্রতি পুরুলিয়ায় বাবার কাছে এসেছেন। তাঁর বাবা কর্মসূত্রে এই শহরে থাকেন। বৃহস্পতিবার শহরের বিভিন্ন এটিএম ঘুরে কোথাও টাকা পাননি আবু। শুক্রবার সকাল থেকেই আরও এক দফা সন্ধানে বেরিয়েছিলেন। লাভ হয়নি। শহরের প্রাণকেন্দ্রে সাহেববাঁধ রোডে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা লাগোয়া এটিএম থেকে বেরিয়ে বললেন, ‘‘পেলাম না। হাতে একেবারে টাকা নেই। দেখি আরও খুঁজে।’’
মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির বাসিন্দা সন্দীপ বিশ্বাস শুক্রবার পুরুলিয়া শহরে এসেছিলেন চাকরির ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য। তিনি বলেন, ‘‘মাত্র তিনশো টাকা ছিল। সেটাই নিয়ে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম এখানে কোনও এটিএম থেকে তুলে নেব। কিন্তু এখন তো দেখছি কোথাও-ই টাকা নেই।’’ সন্দীপ যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন, তার পাশেই একটি এটিএম কাউন্টার। সেটির রক্ষী জানান, কয়েক দিন ধরেই ওই এটিএম বন্ধ রয়েছে। শহরের বাসিন্দা দোলন ঘোষ জানান, সকাল থেকে চারটি এটিএমে ঢুঁ মেরেও হাত খালিই রয়েছে তাঁর।
ব্যাঙ্কের হাল এটিএমের তুলনায় ভাল কিছু নয়। কোর্ট রোডে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখায় গ্রাহকদের লাইন বাইরের রাস্তা পর্যন্ত চলে এসেছিল। ভিতরে মেঝেতে বসে পড়েছিলেন এক বৃদ্ধা। পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার উচালি গ্রামের বাসিন্দা জাগরী কর্মকার নামে ওই বৃদ্ধা জানান, পেনশন তুলতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন সকাল আটটায়। গ্রাম থেকে অনেকটা হেঁটে বাস রাস্তা। বাস ধরে শহরে এসে ব্যাঙ্ক খোলার আগে থেকে টানা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অশক্ত শরীরে ঝক্কি সামলাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মেঝেতেই বসে পড়েন। বেঞ্চে বসে পড়েছিলেন নেবু মাহাতো। ঘড়ির কাঁটা তখন ১টার ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। পুরুলিয়া মফস্সল থানা এলাকার শিমুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ওই প্রৌঢ় বলেন, ‘‘কবে যে এই ভোগান্তির শেষ কে জানে!’’ দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরে লাইন ছেড়ে ফিরে যেতে দেখা গেল শহরের বাসিন্দা রতনকুমার সেনগুপ্তকে।
এ দিন বেলা প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত পুরুলিয়ার জয়পুরের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের দরজা না খোলায় ক্ষোভ ছড়ায় গ্রাহকদের মধ্যে। স্থানীয় বাসিন্দা দেবাশিস দাস বলেন, ‘‘কেন ব্যাঙ্ক খুলছে না সেটাও বলা হচ্ছে না।’’ ওই ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। ব্যাঙ্কটির পুরুলিয়ার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জয়কিষণ দাস বলেন, ‘‘ওই শাখার ম্যানেজার হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় সমস্যা হয়েছিল। তবে পরে এক জন গিয়ে ব্যাঙ্ক খুলেছেন।’’
পুঞ্চা বাজারের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বৃহস্পতিবার নোটিস দিয়ে গ্রাহকদের জানিয়ে দেয়, ১ ও ২ ডিসেম্বর টাকা তোলা যাবে না। তবে ২ তারিখ ওই ব্যাঙ্কে টাকা তোলা গিয়েছে। ব্যাঙ্কের এক আধিকারিক জানান, ২ তারিখ টাকা ঢুকতে হবে ভেবে তাঁরা ওই নোটিস দিয়েছিলেন। তবে বৃহস্পতিবার রাতেই টাকা চলে আসায় শুক্রবার থেকে তা দেওয়া শুরু হয়েছে। তবে এ দিন মানবাজারে হাইস্কুলের সামনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বিকেল ৩টে পর্যন্ত টাকা পাননি গ্রাহকেরা। মানবাজার থানার ডাহা গ্রামের বাসিন্দা জয়গুন বিবি বলেন, ‘‘আমার পেনশনের টাকা অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে বলে মোবাইলে মেসেজ পেয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাঙ্কে আসতে কর্মীরা বললেন টাকা নেই।’’ বান্দোয়ানের বাসিন্দা হাইস্কুলের শিক্ষক প্রমোদ মাহাতো বলেন, ‘‘সকাল থেকে লাইন দিয়েছিলাম। কখন টাকা আসবে জানি না। বাধ্য হয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’’ ওই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার মনোজ ঠাকুর বলেন, ‘‘টাকা শেষ হওয়ার কথা কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম।’’ বিকেলে টাকা দেওয়া শুরু হওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছিলেন গ্রাহকদের একটা বড় অংশ।
আদ্রায় আবার নগদের আকালের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়েছে বিদ্যুৎ। শুক্রবার আদ্রা ডাকঘরে বিদ্যুৎ না থাকায় সকাল থেকে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লেনদেন বন্ধ ছিল। গ্রাহকেরা একপ্রস্ত বিক্ষোভ দেখান। ডাকঘর সূত্রে জানা গিয়েছে, বিদ্যুৎ না থাকলে জেনারেটর চালিয়ে বিকল্প ব্যাবস্থা করা হয়। কিন্তু প্রায় তিন মাস হতে চলল, সেই যন্ত্রও বিকল। ফলে এ কম্পিউটার চলেনি। হয়নি লেনদেন। এ দিন বেলা ১১টা নাগাদ ডাকঘরে গিয়ে দেখা গেল, কাউন্টারের সামনে কয়েকজন গ্রাহকের জটলা। বাকিরা সবাই বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে টাকার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে রয়েছেন। অবসরপ্রাপ্ত চাকুরে সাধন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, সকাল সাড়ে ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। কাউন্টার খোলার পরে জানা গেল, লেনদেন হবে না। বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান থাকায় ডাকঘরের সঞ্চয় প্রকল্প থেকে টাকা তুলতে এসেছিলেন অধুনা আসানসোলের বাসিন্দা বৃদ্ধ গণেশচন্দ্র কর্মকার। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও টাকা পাননি তিনি। এই অবস্থায় গ্রাহকেরা প্রশ্ন তুলেছেন আদ্রার মত বড় ডাকঘরে বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা না থাকা নিয়ে। পোস্টমাস্টার ওঙ্কারনন্দ মণ্ডল বলেন, ‘‘জেনারেটর সারানোর জন্য পুরুলিয়াতে মুখ্য ডাকঘরে জানানো হয়েছে।’’ বেলা সাড়ে ১২টা নাগাদ বিদ্যুৎ আসে। লেনদেন শুরু হয়। কিন্তু ততক্ষণে বহু গ্রাহকই হাল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন।
মাস শুরুর দ্বিতীয় দিনে বেতন ও পেনশনের টাকা তোলার জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা গিয়েছে আদ্রা ও রঘুনাথপুরের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে। কিন্তু পর্যাপ্ত নগদের যোগান না থাকায় হাতে গোনা দুই-তিনটি ব্যাঙ্ক বাদ দিয়ে প্রায় কোথাও গ্রাহকেরা হাজার দশেকের বেশি টাকা তুলতে পারেননি। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তোলার পরে অবসরপ্রাপ্ত ইসিএল কর্মী মতিলাল বাউরি এবং সরকারী কর্মী আশিস চট্টোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘প্রায় সবক’টাই দু’হাজারের নোট। এ বার ভাঙাতে গিয়ে আরও এক দফা মুশকিল।’’ একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ছাড়া দুই শহরের অন্য ব্যাঙ্কগুলির এটিএম ঝাঁপ বন্ধ ছিল।
এখনও ইস্তক হাটেবাজারে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের ব্যাপক প্রচলন না হওয়ায় ভোগান্তি কমেনি বাঁকুড়ার বাসিন্দাদেরও। নগদ টাকার জন্য লাইন পড়েছে ব্যাঙ্কে, এটিএম-এ। কিন্তু লাইনে দাঁড়ালেই যে হাতেগরম টাকা মিলছে, সে কথা কারও মুখেই বিশেষ শোনা গেল না। এ দিন সকালে বাঁকুড়া জেলা মুখ্য ডাকঘরে টাকা তুলতে এসেছিলেন বাঁকুড়া শহরের বাসিন্দা শ্যাম দাস। তিনি জানান, একটি ফিক্সড ডিপোজিটের সদ্য মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। হাতে নগদ টাকার অভাব থাকায় পুরো টাকাটাই তুলেতে চান তিনি। কিন্তু তাঁকে দু’হাজার টাকার বেশি দেওয়া হচ্ছে না। হিসেব করে দেখেছেন, এ ভাবে চললে পুরো টাকা তোলার জন্য তাঁকে টানা এক মাস ধরে রোজ লাইনে দাঁড়াতে হবে। শ্যামবাবুর আক্ষেপ, “অসময়ের জন্যই টাকা জমিয়েছিলাম। কিন্তু লাভ হল কই? এখন নিজের কাজ করব, না রোজ রোজ এসে লাইন দেব টাকা তোলার!’’ ডাকঘরে জমা টাকার সুদ তুলতে এসেছিলেন শহরের রামপুরের বাসিন্দা অরিন্দম বটব্যাল। তিনি ছ’হাজার টাকা তুলছেন। তিনটি দু’হাজারের নোট। গুণতে সুবিধা হয়েছে বটে, কিন্তু ভাঙাতে যে কী অসুবিধা হবে সেই ভাবনা নিয়েই বেরোন তিনি।
এ দিন বাঁকুড়ার বেশিরভাগ ব্যাঙ্কই গ্রাহকদের ১০ হাজার টাকার বেশি টাকা দিতে পারেনি। এ দিকে ব্যাঙ্কে নগদের যোগান সামাল দিতে গিয়ে এটিএমগুলিতে টাকা দেওয়ায় খামতি হচ্ছে। বাঁকুড়া শহরের প্রতাপবাগান এলাকার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক মুকেশ পাত্র বলেন, “ব্যাঙ্কের ভিড় এড়াতে ভেবেছিলাম এটিএম থেকে কিছুটা টাকা তুলে নেব। কিন্তু দিনভর শহরের বিভিন্ন এটিএমে গিয়েও টাকা পাইনি। কিছু এটিএম তো নোট বাতিলের ঘটনার পর থেকে এখনও খোলেইনি।”
এই পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কথা স্বীকার করে নিয়েছেন অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের বাঁকুড়ার সম্পাদক সাগর রায়। সাগরবাবু বলেন, “কর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি মোকাবিলার। তবে প্রতিদিন যেভাবে রিজার্ভ ব্যাংক নতুন নতুন নির্দেশিকা জারি করছে তাতে আমরা সবাই বিভ্রান্ত। চাহিদা মতো গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছি না বলে আমরা প্রশ্নের মুখে পড়ছি।” অবিলম্বে ব্যাঙ্কগুলিতে পর্যাপ্ত টাকা মজুদ করার পাশাপাশি জেলার এটিএমগুলিকেও চালু করার দাবি তুলেছেন তিনি। সাগরবাবুর কথায়, “এটিএম-এ টাকা তোলা গেলে ব্যাঙ্কে ভিড় কমবে। পরিস্থিতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে।”