মথুরানাথের কফিন আঁকড়ে প্রিয়জনদের কান্না।—নিজস্ব চিত্র
তিন মাসের অপেক্ষার শেষ হল। শেষ হল টানা লড়াইয়েরও। অবশেষে সৌদি আরব থেকে ফিরল দুর্ঘটনায় মৃত বরাবাজারের গড়ডি গ্রামের বাসিন্দা যুবক মথুরানাথ গোস্বামীর দেহ। কিন্তু তাঁকে ফিরিয়ে আনতে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি পরিজনদের।
মাসখানেক আগে রোজগারের জন্য সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাস তিনেক আগে খবর আসে রিয়াধে এক পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় তাঁর। কিন্তু খবরটা সহজে মানতে চাননি তাঁর পরিবার-পরিজনেরা। সত্যিই কি মথুরানাথের মৃত্যু হয়েছে, না কি বিদেশ-বিভূঁয়ে কোনও বিপদে পড়েছেন। অফিসের লোকজন তাঁর মৃত্যুর খবর দিয়ে সহজে দায় সারার চেষ্টা করছেন না তো! নানা প্রশ্নের আনাগোনার মধ্যেই তাঁরা ভাবেন, যদি সত্যিই তিনি মারা গিয়ে থাকেন, তাহলে দেহ আনানো যায় না?
কিন্তু রিয়াধ তো অনেক দূর! প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দাদের পক্ষে প্রিয়জনের দেহ ফিরিয়ে আনা মোটেই সহজ নয়। তবে কি তাঁর মুখ শেষবারের মতো দেখা যাবে না— এই প্রশ্নে যখন মথুরানাথের স্ত্রী ও মা আকূল, তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ান বিশ্বদেব গোস্বামী। তিনি মথুরানাথের ভাগ্নে।
বিশ্বদেববাবু জানান, মথুরানাথ আগে কলকাতায় কাজ করতেন। সেখানেই মুম্বইয়ের কোনও একটি সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি ওই সংস্থার মাধ্যমে সৌদি আরবে পাড়ি দেন। কিন্তু ২৯ জানুয়ারি মথুরানাথের গ্রামের বাড়িতে খবর আসে, কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় তিনি আহত হয়েছেন। পরের দিন খবর পাওয়া যায় ওই দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি। দেহ ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সম্ভাব্য বিভিন্ন জায়গায় দরবার করতে ছোটেন। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘মৃতদেহ ফেরত পেতে কার কাছে না গিয়েছি! মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা থেকে প্রশাসনের কর্তা— সবার কাছে শুধু প্রতিশ্রুতি মিলেছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি।’’
‘মদত’ বলে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি হেল্পলাইনেও বিশ্বদেববাবু যোগাযোগ করেন। কিন্তু ফল মেলেনি। শেষে বিভিন্ন দরজায় ঘোরাঘুরি বন্ধ করে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রাথমিক স্কুলের এই শিক্ষক ওয়েবসাইট থেকে সৌদি আরবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অফিসের ঠিকানা জোগাড় করে নিজেই সরাসরি যোগাযোগ করেন। তাঁর কথায়, ‘‘সৌদি আরবে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের অফিসে ই-মেল করে ঘটনাটি জানিয়ে দেহ ফেরত পাওয়ার আর্জি জানাই। কয়েকদিনের মধ্যে তাঁরা জানান, বিষয়টি দেখছেন। একজন স্বেচ্ছাসেবককে এই কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলেও আশ্বাস দেওয়া হয়।’’
তিনি জানান, এর বেশ কিছুদিন পরে কলকাতায় দমদম বিমানবন্দরের কারগো অফিস থেকে তাঁদের কাছ থেকে মথুরানাথের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানতে চাওয়া হয়। শেষমেশ বুধবার দমদম বিমানবন্দর থেকে মথুরানাথের কফিনবন্দি দেহ হাতে পান বাড়ির লোকজন। বিশ্বদেববাবু জানান, খুব ঠাণ্ডার মধ্যে দেহটি যত্ন নিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই মাথায় যে ক্ষত হয়েছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল। মুম্বইয়ের ওই সংস্থাও দেহ ফেরত পেতে সাহায্য করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
মথুরানাথ শৈশব থেকেই নবদ্বীপে কাটিয়েছেন বলে সেখানেই বৃহস্পতিবার তাঁর দেহের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তবে তার আগে পরিজনেরা দেহটি শেষবাবের মতো দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁদের এই আশা পূরণের জন্যই তো লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন বিশ্বদেববাবু।