দীপক খুনে উঠছে অনেক প্রশ্ন

এই মৃত্যু বীরভূমের ওই অঞ্চলে নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দীপকবাবুর উপরে হামলা যে প্রত্যাশিতই ছিল, তা নিহত নেতার অনুগামী এবং আত্মীয়দের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। তাঁদের দাবি, খয়রাশোলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকায় দীপকবাবুর ক্রমশ শত্রু বৃদ্ধি হচ্ছিল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

খয়রাশোল ও দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:৫২
Share:

শেষশ্রদ্ধা: দুর্গাপুরে দীপক ঘোষের মরদেহে মালা দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারা। সোমবার। নিজস্ব চিত্র

দু’বছর আগেও শরীরে গুলি বিঁধেছিল। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এ বার হল না। ব্লক সভাপতি পদে বসার চার মাসের মধ্যেই খুন হয়ে গেলেন খয়রাশোলের দাপুটে তৃণমূল নেতা দীপক ঘোষ।

Advertisement

এই মৃত্যু বীরভূমের ওই অঞ্চলে নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দীপকবাবুর উপরে হামলা যে প্রত্যাশিতই ছিল, তা নিহত নেতার অনুগামী এবং আত্মীয়দের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার। তাঁদের দাবি, খয়রাশোলে ক্ষমতার শীর্ষে থাকায় দীপকবাবুর ক্রমশ শত্রু বৃদ্ধি হচ্ছিল। এ বছর পঞ্চায়েত ভোটের আগেই দীপকবাবুকে কার্যকরী সভাপতি থেকে উন্নীত করে ব্লক সভাপতি করেন জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ জয়ের পরে দীপকবাবুর প্রভাব আরও বাড়ছিল।

তৃণমূল সূত্রের খবর, দলের জন্মলগ্ন থেকে খয়রাশোলের ব্লক সভাপতি ছিলেন সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০০৭ সালে ব্লক সভাপতি হন অশোক মুখোপাধ্যায়। তখনও দীপকবাবুর দাদা অশোক ঘোষ কংগ্রেসে। কিন্তু, প্রচুর লোকবল ছিল তাঁর। শতাব্দী রায় ২০০৯ লোকসভা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পরে প্রথমে তাঁকে সমর্থন ও পরে সরাসরি তৃণমূলে যোগ দেন অশোক ঘোষ। সেই থেকে খয়রাশোলে দুই অশোকের সংঘাত শুরু। সংঘাত ক্ষমতা দখলে রাখার। বিরোধীদের অভিযোগ, আসলে কয়লার চোরা কারবারের রাশ কোন গোষ্ঠীর হাতে থাকবে, সেই নিয়েই দুই অশোকের দ্বন্দ্ব ছিল।

Advertisement

দলের নেতাদের একাংশ জানাচ্ছেন, ২০১১ সালের পরে অশোক ঘোষকে ব্লক সভাপতি করে দিলে দুই অশোকের সংঘাত আরও বাড়ে। তবে অনুব্রতর বিরোধী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন অশোক ঘোষ। ’১৩ সালে অশোক মুখোপাধ্যায়কে ফের ব্লক সভাপতির পদে আনা হয়। ওই বছরই আততায়ীর হাতে অশোক ঘোষের মৃত্যু এবং রাজনীতিতে দীপক ঘোষের সক্রিয় হওয়া শুরু। তার আগে তেমন ভাবে কেউ চিনতেনই না দীপককে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ার মতো উত্থান হয় দীপকবাবুর। শেষ পর্যন্ত ব্লক সভাপতি। এত দ্রুত ক্ষমতায় আসারই কি মাসুল দিলেন ওই নেতা— এমন প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে খয়রাশোলে।

অনুগামীদের আরও দাবি, বহুবার তাঁরা দীপকবাবুকে সতর্ক করে বলেছেন, দলের মধ্যেই তাঁর শত্রু অনেক। মোটরবাইকে নয়, কোথাও যেতে হলে গাড়িতে সঙ্গীসাথী নিয়ে যাওয়া উচিত। একই আক্ষেপ দীপকবাবুর ভাইপো, অশোক ঘোষের ছেলে বিশ্বজিতের। তাঁর কথায়, ‘‘যে কোনও মূহূর্তে ফের বিপদ আসতে পারে বলে বারবার সতর্ক করেছিলাম কাকাকে। কিন্তু উনি কথা শোনেননি।’’ অনুগামীদের ধারণা, পূর্ব পরিকল্পনা করেই খুন করা হয়েছে দীপকবাবুকে। রবিবার দুপুরে তিনি যে মোটরবাইকে হিংলো নদীর চর ধরে শর্টকাট পথে বাড়ি ফিরবেন, তা কারও জানার কথা নয়। তবু কী করে হামলা হল ওই পথে, সে প্রশ্ন উঠেছে দলের অন্দরে।

পুলিশের গাফিলতির দিকেও আঙুল তুলেছেন বিশ্বজিৎ। তাঁর দাবি, খয়রাশোল ব্লকের একটি থানার ওসি এলাকায় অশান্তির জন্য দায়ী। এ দিন দুর্গাপুরে হাসপাতাল চত্বরেই তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘খয়রাশোলে তৃণমূলকে শেষ করে দিতে শত্রু শিবিরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ওই ওসি এ সব করছেন। তাঁকে দ্রুত অপসারণের জন্য পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’’ বেআইনি কয়লার কারবারে তাঁর পরিবারের কেউ যুক্ত নন বলে দাবি করে বিশ্বজিতের দাবি, ‘‘আমার কাকা থাকাকালীন বেআইনি কয়লার কারবার চালু করতে পারেনি গেরুয়া দুষ্কৃতীরা। তাই তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। এর আগেও কাকা ও দলের বিভিন্ন অঞ্চল সভাপতির উপরে হামলা হয়েছে। ২০১৬ সালে কাকার উপরে হামলার ঘটনার পরে ওই ওসি অভিযুক্তদের ধরতে গা করেননি। সে দিন তিনি তৎপর হলে আজ এত বড় ঘটনা হয়তো ঘটত না।’’ লিখিত অভিযোগ জানানোর সময় এই কথাগুলো লিখবেন বলেও তিনি জানান। জেলা পুলিশ সুপার কুণাল আগরওয়াল বলেন, ‘‘ঘটনায় এখনও লিখিত অভিযোগ হয়নি। তবে তদন্ত এগোচ্ছ। কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতেই পারেন। বাধা নেই।’’

দীপক-খুনের নেপথ্যে দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বা বেআইনি কয়লা কারবারের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন দুবরাজপুরের বিধায়ক নরেশ বাউড়ি। তাঁর দাবি, ‘‘এটা দুষ্কৃতীদের কাজ। সবাইকে নিয়ে খয়রাশোলের উন্নয়নে ব্রতী হয়েছিলেন দীপক ঘোষ। কিছু দুষ্কৃতীর তাতে সমস্যা হচ্ছিল। তারাই এই ঘটনা ঘটিয়েছে।’’ দল সূত্রের খবর, এ দিন সন্ধ্যায় খয়ারাশোলের দলীয় কার্যালয়ে নিহত নেতার মরদেহ শেষ শ্রদ্ধার জন্য কিছুক্ষণ রাখা হয়। শেষকৃত্য হয় বক্রেশ্বর মহাশ্মশানে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement