সঙ্গী: উচ্চ মাধ্যমিকের শেষ দিনে রাইটার পাশে নসিফা। তার আক্ষেপ, প্রথম থেকে এই সাহায্য পেলে আরও ভাল পরীক্ষা দিত সে। নিজস্ব চিত্র
আশি শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও উচ্চ মাধ্যমিকে অধিকাংশ বিষয়ে লেখক (রাইটার) নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারল না এক ছাত্রী। শেষ পর্যন্ত অবশ্য উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের নজরে আসায় শেষ দু’টি পরীক্ষায় লেখক পেল রঘুনাথপুর ২ ব্লকের চেলিয়ামার বি সি গার্লস হাইস্কুলের নাসিফা খাতুন।
কিন্তু যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেন লেখক পেল না নাসিফা? এ নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পরীক্ষার্থীর অভিভাবকেরা একে অপরকে দুষছেন। মূলত পরীক্ষাকেন্দ্রের পর্ষদের মনোনীত প্রতিনিধি মিসির আলি আনসারির উদ্যোগেই শেষ দু’টি পরীক্ষায় লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিতে পেরেছে ওই ছাত্রী।
রঘুনাথপুর ২ ব্লকের বামড়রা গ্রামের মেয়ে নসিফার পরীক্ষা কেন্দ্র হল বড়রা অঞ্চল হাইস্কুল। এই স্কুলেই পর্ষদের মনোনীত প্রতিনিধি মিসির আলি জানান, ইতিহাস পরীক্ষার দিনে তিনি লক্ষ করেন নসিফা নামের ওই ছাত্রী চোখের খুব কাছে প্রশ্নপত্র এনে দেখছে ও খাতার উপরে প্রায় মাথা ঠেকিয়ে উত্তর লিখছে। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়েটিকে ওইরকম ভাবে লিখতে দেখে সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, নসিফা ৮০ শতাংশ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তাহলে কেন মেয়েটি উত্তর লেখার জন্য লেখক পায়নি? খোঁজ নিতে সে দিনই বিসি গার্লস হাইস্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও পর্ষদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করে নসিফার লেখকের ব্যবস্থা করা হয়।’’
বুধবার উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ করে নসিফা বলে, ‘‘প্রশ্নপত্র চোখের সামনে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া ও কষ্ট করে লিখতে প্রচুর সময় নষ্ট হয়েছে। তবে লেখক পাওয়ার পরে সময় বেঁচেছে।’’
জন্মের পর থেকেই মেয়ে চোখে কম দেখে বলে জানাচ্ছেন পেশায় দিনমজুর নসিফার বাবা শেখ সারাফত। সাধ্যমতো মেয়ের চোখের চিকিতসা করানোর চেষ্টা করেছিলেন বটে, কিন্তু আর্থিক সামর্থ্যে কুলোয়নি বলে চিকিৎসা সম্পূর্ন হয়নি।
তিনি জানান, নসিফা মাধ্যমিকেও লেখক ছাড়াই পরীক্ষা দিয়েছিল। তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয় ভর্তি হয় নিজের স্কুলেই। নসিফার দাদা নাকিবুলের অভিযোগ, ‘‘লেখক নিয়ে বোন যাতে পরীক্ষা দিতে পারে, সে জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছিলাম। পরে আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বোনও লেখক পায়নি।’’
বি সি গার্লস হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষিকা চৈতালী মজুমদারের দাবি, উচ্চ মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষা হওয়ার পরে নসিফা একদিন স্কুলে এসেছিল। তখন তাকে লেখক নেওয়ার জন্য আবেদন করার ও নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তারপরে নসিফা বা তার অবিভাবকেরা স্কুলে যোগাযোগ করেনি।
চৈতালীদেবী বলেন, ‘‘নসিফা যাতে লেখক নিয়ে পরীক্ষা দিতে পারে সেই জন্য আমরা মেদিনীপুরের পর্ষদ অফিস থেকে ফর্ম এনে স্কুলে রেখেছিলাম। কিন্তু সে আর স্কুলে যোগাযোগই করেনি। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে যাওয়ায় উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা স্কুলে না আসায় নসিফার সঙ্গে আর যোগাযোগও করা যায়নি।”
যদিও জেলার পরীক্ষা পরিচালন সমিতির যুগ্ম আহ্বায়ক হংসেশ্বর মাহাতো ও সমিতির সদস্য কল্যাণপ্রসাদ মাহাতোরা মনে করেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রেই গ্রামাঞ্চলের ছাত্রছাত্রী ও তাদের অবিভাবকেরা নিয়ম জানেন না বলে সমস্যায় পড়েন। কিন্তু আমরা সব সময়েই স্কুল কর্তৃপক্ষকে বলে থাকি, তাঁরা যেন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এই সমস্যাগুলি মানবিকতার সাথে দেখেন।”
নসিফার ক্ষেত্রে বিসি গার্লস হাইস্কুলের কর্তৃপক্ষের বাড়তি উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল বলে মত পরীক্ষা পরিচালন সমিতির দুই সদস্যের।