বোলপুর এসডিও-র দফতরে মনোনয়ন চলাকালীন দেখা হয়ে গেল একসময়ের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল ও সিপিএমের জেলা সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য সমীর ভট্টাচার্যের। দু’জনে হাত মেলালেন।
জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের ইস্তফা দেওয়ার পর জেলাজুড়ে পুরভোটের মনোনয়নকে কেন্দ্র করে বিজেপির তুমুল গোষ্ঠী কোন্দল ছড়িয়ে পড়ল। প্রার্থীদের নামের তালিকা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করার আগেই, কোথাও নিজেরাই মনোনয়ন পত্র জমা দিলেন খোদ বিজেপি প্রার্থীরা, তো কোথাও প্রার্থী বাছাই নিয়ে ঘোর অসন্তোষ থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি দলের একাংশের পছন্দেই মনোনয়ন জমা দিলেন। অন্যদিকে দুধকুমারের ইস্তফাকে ঘিরে দিনভর জেলায় পদত্যাগের হিড়িক চলল বিভিন্ন স্তরের বিজেপি নেতা-কর্মীদের মধ্যে।
অন্যদিকে এ দিনই সিউড়িতে দলের মহিলা মোর্চার সভানেত্রী স্বাগতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও নিজের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। দুধকুমার পদত্যাগ করার জন্যই তিনি পদত্যাগ করছেন সেটা অবশ্য তিনি বলছেন না। স্বাগতার দাবি, “সিউড়ি শহরের বাসিন্দা আমি, পুরভোটে দলের হয়ে যে সাত জন মহিলা প্রার্থী হচ্ছেন বলে জেনেছি। তাঁদেরকে কখনও দল করতে দেখিনি। বা তাঁরা কথনও দলের জন্য সময়ও দেননি। ওঁরা পরিবারতন্ত্রের জন্য না অর্থতন্ত্রের জন্য প্রার্থী পদ পেলেন সেটা অজানা। মানুষেকে প্রতারিত করতে চাই না বলেই ইস্তফা দিয়েছি।”
এ দিন সিউড়িতে জেলা সংখ্যালঘু ভবনে তৃণমূল কংগ্রেস-বামেদের পাশাপাশি বিজেপির দুই প্রার্থী নিজেদের মনোনয়ন জমা দেন। তফাত্ একটাই, অন্য সকল রাজনৈতিক দলের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হলেও, রামপুরহাট ছাড়া জেলার অন্য তিন পুরসভায় তখনও বিজেপি তালিকা প্রকাশ হয়নি। ওই দুই প্রার্থী দীপক দাস ওরফে বাবন এবং প্রভাতী সিংহরায় এ দিন জানান, দল রবিবারই তাঁদের নাম চূড়ান্ত তালিকায় পাঠিয়েছে। সেই কারণেই তাঁরা আজকেই মনোনয়ন জমা দেন। যদিও সিউড়ির দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা তথা সাধারণ সম্পাদক গৌতম তিওয়ারি দাবি করেন, “চূড়াম্ত তালিকার কথা জানি না। তবে তাড়াতাড়ি চলে আসবে। যাঁরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন, তাঁরা অতি উত্সাহে সেটা করেছেন। বাকিরা পরে দেবেন।”
একই ছবি বোলপুরেও। এ দিন বোলপুরে ২০ টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৪টি ওয়ার্ডের মনোনয়ন পত্র জমা দেয় বিজেপি। জেলা সহ-সভাপতি তথা বোলপুরের পুরভোটের দায়িত্ব প্রাপ্ত নেতা দিলিপ ঘোষ বলেন, “সোমবার ১৪টি ওয়ার্ডের মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়েছে। তবে ২০টি ওয়ার্ডে প্রার্থীই চূড়ান্ত হয়েছে।”
পদত্যাগী বিজেপির মহিলা নেত্রী স্বাগতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঘটনা হল, বোলপুরের পুরভোট সংক্রান্ত বিষয় দিলিপ ঘোষের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে দিন দুয়েক আগে জানিয়েছিলেন দুধকুমার। দলের অন্দরের খবর, এতে বিজেপির একটি অংশ আপত্তি তোলে। আর পুরভোট সংক্রান্ত দলীয় বৈঠকে দিন দুয়েক আগে একাধিক জায়গায় প্রার্থী নিয়ে মতের অমিল হওয়ায় রবিবার জেলা সভাপতি পদ থেকে সরেও দাঁড়ান দুধকুমার। কেন অন্য রাজনৈতিক দলগুলির মতো আনুষ্ঠানিকভাবে বিজেপি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করল না? উত্তরে দিলিপবাবুর ব্যাখ্যা, “এক একটি ওয়ার্ডে পাঁচ, ছটি করে নাম উঠে আসছে। কৌশল গত ভাবে আমরা অনুষ্ঠান না করার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
প্রসঙ্গত, বোলপুর পুরভোটে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের বিরোধিতায় শহরে ভোট করার জন্য জেলা বিজেপির একাংশ পাড়ুইয়ের বিজেপি নেতা নিমাই দাসকে চেয়েছিল। সে নিয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয় নিজেদের মধ্যে। অতীতের অনুব্রত-ঘনিষ্ঠ নিমাইকে ভর করেই কার্যত বোলপুরে তৃণমূলকে পুরভোটে চ্যালেঞ্জ জানাতে চেয়েছিল তারা। সূত্রের খবর, তাতে দলের একটি মহল ঘোর আপত্তি জানায়।
কার্যত রবিবার বিকালে দুধকুমারের পদত্যাগের পদক্ষেপ জেলা জুড়ে কর্মীদের একাংশের মধ্যে অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। দুধকুমারকে পদে বহাল রাখার দাবিতে পদত্যাগ করতে চেয়ে এবং গণ ইস্তফার হুমকি দিয়ে প্রদেশ নেতৃত্ব ও জেলার পর্যবেক্ষের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন মযূরেশ্বর ২ ব্লক এলাকার নেতা-কর্মীরা। এ দিন ওই ব্লকের কোটাসুরে বিজেপি-র দু’নম্বর মণ্ডল কমিটির কার্যালয়ে সকাল থেকে ছিলেন দুধকুমার। দিনভর সেখানে স্থানীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের জেলা কমিটির সদস্য তমাল মণ্ডল, সংশ্লিষ্ট মণ্ডল কমিটির সভাপতি প্রবীর মণ্ডল, ব্লক সভাপতি বাবলু মণ্ডল, মহিলা মোর্চার তৃপ্তি দাস এবং ময়ূরেশ্বর, ঢেকা, কুণ্ডলা, দশপলসা ষাটপলশা, কলেশ্বর ও উলকুণ্ডা অঞ্চল কমিটির সভাপতি-সহ বেশ কিছু নেতা-কর্মী পদত্যাগের চিঠিতে সই করেছেন।
দুধকুমার এ দিন বলেন, “জেলার প্রার্থী নিয়ে আমার সঙ্গে চূড়ান্ত কথা হয়নি। দলকে দুটো ভাগ করার জন্য বীরভূম জেলায় দলের কিছু সদস্য, নেতা-কর্মী নিজেদের স্বার্থে আমাকে তাড়াবার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা যেমন ঠিক, অন্য দিকে দলের বড় অংশ আমার জন্য পদত্যাগ করছেন।”
—নিজস্ব চিত্র।