চিন্তিত দুধকুমার। দলের স্টিয়ারিং এখন যাঁর হাতে।
পদত্যাগপত্র গৃহীত হল। অথচ নতুন কাউকে জেলা সভাপতির পদে বসানোও হল না। বরং ‘জেলা আহ্বায়ক’ বলে একটি নতুন পদ তৈরি করে পুরভোটের মুখে বীরভূম বিজেপি-র দায়িত্বে আনা হল দলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি অজুর্ন সাহাকে। এর সঙ্গে সঙ্গেই ‘প্রাক্তন’ কথাটি জুড়ে গেল সদ্য পদত্যাগী জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের নামের আগেও!
আসন্ন পুরভোটকে মাথায় রেখে দলের অন্দরে ‘বিদ্রোহে’র আগুন চাপা দিতে আপাতত এমন রাস্তাই বেছে নিল বিজেপি-র রাজ্য নেতৃত্ব। মঙ্গলবার দলের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ বলেন, “দলের বীরভূম জেলা সভাপতি দুধকুমার মণ্ডলের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। তাঁকে ঠিক ভাবে দলের কাজ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।” তিনি জানান, আপাতত অর্জুনবাবু জেলার আহ্বায়ক হিসেবে কাজ চালাবেন। ১০-১২ জনকে নিয়ে একটি কমিটি গড়ে তিনি পুরভোটটা সামলে দেবেন। তার পরে দলীয় সংবিধান মেনে বীরভূমে নতুন জেলা সভাপতি নিয়োগ করা হবে।
এ দিন বিজেপি রাজ্য সভাপতি দুধকুমারের বক্তব্যের তীব্র বিরোধিতাও করেছেন। পদত্যাগ করার সময়ে দুধকুমার পুরভোটে টিকিট পাওয়ার বিনিময়ে রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে টাকা নেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে রাহুলবাবু বলেন, “দুধকুমার মণ্ডল সংবাদমাধ্যমে অভিযোগ করেছেন, রাজ্যের কোনও কোনও নেতা অর্থের বিনিময়ে পুরভোটে প্রার্থী ঠিক করেছেন। কারা এই কাজ করেছেন, তা দল ওঁর কাছে জানতে চায়। উনি প্রমাণ-সহ তথ্য পেশ করুন।” তাঁর চ্যালেঞ্জ, “কোনও কার্যকর্তা রাজ্যের কোনও পদাধিকারীর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে আমি তার দায় নিতে তৈরি আছি। এত বড় চ্যালেঞ্জ করছি, কারণ প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজ্য নেতাদের কোনও সুপারিশ ছিল না।” তাঁর দাবি, ওয়ার্ড, মণ্ডল ও জেলা সভাপতি এবং জেলা ও রাজ্যের পর্যবেক্ষক মিলে প্রার্থী বাছাই করেছেন। রাজ্য নেতারা সেই নামগুলিকেই অনুমোদন করেছেন। যে সব ক্ষেত্রে বিতর্ক ছিল, সেখানে ওই পাঁচ নেতার মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত মেনে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে, দুধকুমারের তোলা জেলায় দলের অন্দরে গোষ্ঠী তৈরিতে শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশের মদত দেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে এ দিন রাহুলবাবু কিছু বলেননি।
যদিও পরিস্থিতি দেখে এ দিন অনেকটাই সুর নরম করেছেন দুধকুমারও। অনেকটা দার্শনিকের ঢঙে তিনি বলছেন, “যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। যা হবে তা ভালোই হবে।” এ দিন বিকালে ময়ূরেশ্বরের কোটাসুরে নিজের বাড়িতে দুধকুমার মুখে এ কথা বললেও কোথাও যেন একটা তাল কেটে গিয়েছে। সোমবারই রাজ্য নেতৃত্বের কাছে তাঁকে স্বপদে বহাল রাখার দাবি জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন দুধকুমারের অনুগামীরা। দাবি মানা না হলে ছিল পদ ও দল ছাড়ার হুমকিও। তার মধ্যেই এমন সিদ্ধান্তের খবর এল।
এত কিছুর পরেও দলের নেতাদের একাংশের প্রতি ক্ষোভ মিটছে না দুধুমারের। এ দিন বিকেলে দলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত এবং অর্জুনবাবুকে অভিনন্দন জানিয়েও ক্ষুব্ধ দুধকুমার বলেন, “অনেক লড়াই করেছি। প্রথমে সিপিএম এবং পরে তৃণমূলের সঙ্গে। বহু মানুষের রক্ত, ঘাম ও পরিশ্রমে যে কোনও রাজনৈতিক দল মজবুত জায়গায় পৌঁছয়। তাঁদের মিলিত পরিশ্রমের ফলেই বড় নেতারা ঠান্ডা ঘরে বিবৃতি দিতে পারেন। কিন্তু, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তাঁরা নেতা হওয়ার পরে সেই সব নেপথ্যে থেকে যাওয়া মানুষের কথা মনে রাখেন না। বিজেপি-তেও এমন নেতার অভাব নেই!” প্রার্থীপদের বিনিময়ে টাকা তোলার অভিযোগ নিয়ে রাহুলবাবুর কড়া প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য অনেকটাই পিছু হঠেছেন দুধকুমার। এ দিন তাঁর বক্তব্য, “এমন কথা বলা ভুল হয়েছে। দলের অন্য নেতাদের কথা শুনে এমন বলে ফেলেছি। প্রার্থীপদের বিনিময়ে টাকাপয়সা নেওয়ার কোনও তথ্য প্রমাণ আমার হাতে নেই। দল জানতে চাইলে আমার ভুল স্বীকার করে নেব।”
সাঁইথিয়ায় অর্জুন সাহা। ছবি: অনির্বাণ সেন।
এ দিকে, অর্জুনবাবুর নিয়োগকে ঘিরে দুধকুমারের অনুগামীদের একটা বড় অংশই অসন্তুষ্ট বলে খবর। তাঁদের কেউ কেউ ঘনিষ্ঠ মহলে জেলা আহ্বায়কের সঙ্গে অসহযোগিতা করার কথা ভাবছেন বলেও জানিয়েছেন। তবে, পুরভোটের আগে দুম করে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছিল, তা থেকে অনেকটাই মুক্তি মিলল বলে মনে করছে দলেরই আর এক অংশ। তাঁদের বক্তব্য, “অর্জুনবাবু মাটির মানুষ। খুব সহজেই সবার সঙ্গে মিশে যান। আগে জেলা সভাপতির দায়িত্বও সামলেছেন। তিনি সবাইকে এক করে পরিস্থিতি ঠিক সামলে দেবেন।” ময়ূরেশ্বর ১ ব্লকের কালিকাপুরের বাসিন্দা অর্জুনবাবু ২০১০-’১১ সাল পর্যন্ত দলের জেলা সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। ২০১২ সালে তাঁকে সরিয়েই দুধকুমারকে জেলা সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। দলেরই একটি সূত্রের খবর, ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হওয়া আটকে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেননি অর্জুনবাবু। সেই সময় বা পরে প্রকাশ্যে এ নিয়ে মুখ না খুললেও দুধকুমারের সঙ্গে যে তাঁর সম্পর্ক মসৃণ ছিল, এ কথাও খুব জোর দিয়ে বলতে পারছেন না জেলা নেতারা।
নতুন দায়িত্ব পেয়ে অর্জুনবাবু অবশ্য বলছেন, “দলের সমস্ত কর্মী ও নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সাধ্যমতো দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করব। এমনকী, গত দু’দিনে যাঁরা আবেগতাড়িত হয়ে পদ এবং দল ছেড়েছেন, তাঁদের কাছেও যাব। প্রয়োজনে পরামর্শ নেব দুধকুমারবাবুর কাছেও।” তাঁর আশা, লোকসভা ভোটের মতোই পুরভোটেও মানুষ বিজেপি-র প্রতি আস্থা রাখবেন।