ধানগোড়ায়, বেলিয়াড়ায় বিষ্ণুপুরের জোট প্রার্থীর প্রচার। ছবি: শুভ্র মিত্র।
গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে পালাবদলের মাস খানেকের মধ্যেই বিষ্ণুপুরের জন্তা গ্রামের সিপিএম কর্মী সীতারাম কুণ্ডুকে শাবল দিয়ে কুপিয়ে খুন করে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। অভিযোগ ওঠে আততায়ীরা তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী। সে দিনই বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্রের রাধানগর ও উলিয়াড়া অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির সিপিএম কর্মীরা বুঝে নেন, প্রাণ বাঁচাতে গেলে লাল পার্টির পতাকা আর হাতে নেওয়া চলবে না। ভয়ে বহু সিপিএম কর্মী গ্রামও ছাড়েন। যাঁরা থেকে যান, তাঁদের অন্য ভাবে মূল্য চোকাতে হয়।
এর পর পার হয়ে গিয়েছে পঞ্চায়েত ও লোকসভার ভোট। কোনও নির্বাচনেই বামকর্মীরা মাঠে নামেননি। এই সব গাঁয়েও বাম নেতাদের পা পড়েনি। উলিয়াড়া গ্রাম পঞ্চায়েত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে শাসকদল তৃণমূল।
হঠাৎই উল্টো চিত্র দেখা গেল শুক্রবার। বিষ্ণুপুরের জোট প্রার্থী কংগ্রেসের তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের মিছিলে হাঁটলেন উলিয়াড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের ধানগড়া, বেলিয়াড়া, ডিহর, বসন্তপুর, শান্তিপুর, প্রকাশঘাটের কয়েকশো মানুষ। আকাশে কংগ্রেসের সঙ্গেই উড়ল সিপিএমের লাল ঝান্ডা। শাসকদলের বিরুদ্ধে স্লোগানও উঠল। রাজনৈতিক মানচিত্রে এই সব ক’টি গ্রামই বামেদের কথায় ‘সন্ত্রাস কবলিত’।
কেন? এলাকার সিপিএম নেতা-কর্মীরা জানাচ্ছেন, পালাবদলের পর বহু সিপিএম কর্মী ঘর ছাড়া হয়েছিলেন এই সব এলাকা থেকে। ধীরে ধীরে তাঁরা ফিরে এলেও প্রকশ্যে দলের কোনও কাজ করেন না। বস্তুত সিপিএমের নাম উচ্চরণ করতে অনেকে সাহস পান না। পার্টি করা তো দূরের কথা। এ দিনের মিছিলে ছিলেন বিষ্ণুপুরের প্রাক্তন বিধায়ক তথা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য স্বপন ঘোষ, তালড্যাংরার প্রাক্তন বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্রেরা। স্বপনবাবুর অভিযোগ, ‘‘এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত প্রকাশ্যে দলের কাজ করা তো দূর, সিপিএমের পতাকা টাঙানোও এই সব এলাকায় নিষিদ্ধ ছিল। কাউকে এই কাজ করতে দেখলেই মারধর করে জরিমানা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে।’’ তারপরেও মানুষ মিছিলে বের হলেন কী ভাবে? স্বপনবাবুর দাবি, “এই সব মানুষেরাই গত বিধানসভা ভোটে রাজ্যে বদল ঘটিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পরিবর্তন যে ভুল ছিল তাও তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। তৃণমূলের দুর্নীতি, রাহাজানি এতটাই মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে যে মানুষ প্রতিবাদ জানাতে পথে নামতে বাধ্য হচ্ছেন। মানুষের জোট তাঁদের সেই সাহস জুগিয়েছে।”
ঘটনা হল, এই সব গ্রামের বেশির ভাগ বাসিন্দাই বিষ্ণুপুর দ্বারিকা শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন কল-কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। রাজ্যে পালাবদলের পরে ওই শিল্পাঞ্চলের বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে শ্রমিকদের ঘরে ঘনিয়েছে অন্ধকার। এ ছাড়া গ্রামের উন্নয়ন নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে বাসিন্দাদের। বস্তুত দিকে দিকে এখন বাম ও কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের একজোট হয়ে মিছিল করতে দেখে এলাকায় সাহস ছড়িয়েছে। তাঁদের অনেকেই এখন নিরবতা ভেঙে বলছেন— গ্রামের পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে পারেনি পরিবর্তনের সরকার। গ্রামের রাস্তাঘাট সংস্কারও হয়নি। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মিছিলে পা মেলানো গ্রামবাসীদের অনেকেই বলছেন, “না কাজ দিতে পেরেছে, না উন্নয়ন করতে পেরেছে এই সরকার। বরং চোখের সামনে দেখলাম দলের কিছু নেতা-কর্মীরা কী ভাবে নিজেদের সম্পত্তি বাড়িয়ে নিল। বাঁচার তাগিদেই তাই রাস্তায় নেমেছি।”
যদিও জোট প্রার্থীর এই মিছিলকে পাত্তাই দিতে চাইছেন না যুব তৃণমূলের ব্লক সভাপতি তথা বিষ্ণুপুর পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর উদয় ভকত। তিনি বলেন, “হাতে গোনা ক’টা লোক হয়েছিল শুনেছি। তবে ভোট যত এগিয়ে আসবে তত লোকও ওদের কমতে থাকবে। শেষ পর্যন্ত ওরা বুথে বসার লোক খুঁজে পাবে তো?”
সাংগঠনিক ত্রুটির মেরামত করতে না পারলে আখেরে ফল যে বিপক্ষেই যাবে তা অবশ্য বুঝেই গিয়েছে বাম-কংগ্রেস জোট। তাই সেই প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছে বলেই জানাচ্ছেন স্বপনবাবু। তিনি বলেন, “যে ছ’টি গ্রামে আমাদের মিছিল হয়েছে সেখানে মোট সাতটি বুথ রয়েছে। সত্যি বলতে কিছুদিন আগেও ওই বুথে আমরা এজেন্ট দেওয়ার মত অবস্থায় ছিলাম না। তবে যে ভাবে এ দিন মানুষ বেরিয়ে এসেছেন তাতে আর কিছুই অসম্ভব নয়।” তিনি জানান, বুথে এজেন্ট দেওয়া তো বটেই, ছাপ্পা ও রিগিং রুখতে গ্রামের মহিলাদের সামনে আনার ছকও কষে ফেলেছেন তাঁরা।