ফাইল ছবি
বক্সা জঙ্গলে বাঘের ছবি দেওয়া ‘সাইনবোর্ড’ দেখা যায় কিছু দূর অন্তরই। কিন্তু গত কয়েক বছরে বাঘের দেখা মিলেছে মোটে একবার। মাত্র কয়েক মাস আগে। পরিবর্তে জঙ্গলের গভীরে, যাকে বন দফতরের পরিভাষায় বলে ‘কোর এরিয়া’, সেখানে রাতের পর রাত অন্য ছায়ামূর্তিদের দেখা মেলে। তাদের কেউ চোরা শিকারি, কেউ কাঠ মাফিয়া।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরেই এমন একটি ঘটনায় প্রাণ যায় বনকর্মী কার্তিক গুহ রায়ের। দক্ষিণ রায়ডাক রেঞ্জের রায়ডাক বিটে তাঁরা তখন টহল দিচ্ছিলেন। শীতের রাতে অন্ধকার এবং কুয়াশায় জঙ্গলে ভাল করে কিছু ঠাহর হচ্ছিল না। অভিযোগ ওঠে, কাঠ মাফিয়াদের একটি দল তখন সেই এলাকায় ‘অপারেশন’ চালাচ্ছিল। তাদের ভয় দেখাতে বনকর্মীদেরই কেউ ছররা গুলি চালান। সেই গুলি লাগে কার্তিকের গায়ে। মারাত্মক জখম অবস্থায় শিলিগুড়ির একটি নার্সিংহোমে তাঁকে নিয়ে আসা হয়। কয়েক দিন পরে তিনি মারা যান।
বাঘ থাকুক বা না থাকুক, অন্ধকারে বক্সা জঙ্গল তাই সমান ‘বিপজ্জনক’।
সেই জঙ্গলে ঘুরলেই বোঝা যায়, গাছের সংখ্যা যেন কমে এসেছে। বেশ কয়েক বছর আগে কালিম্পঙে পোস্টিং হয়েছিল সদ্য চাকরিতে যোগ দেওয়া এক যুবকের। এলাকার জঙ্গলে ঘুরে তিনিও বলেছিলেন, ‘‘ভিতরটা যেন ফোকলা হয়ে গিয়েছে।’’ কারণ খুঁজতে শুরু করার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর কাছে সতর্কবার্তা আসতে শুরু করে। পরে বদলিও হয়ে যান তিনি।
পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্স, তিন জায়গাতেই কাঠ চুরির চক্র কী ভাবে জাল বিছিয়ে রেখেছে, তা সেই সব জায়গায় কাজ করা পুলিশ-প্রশাসনের লোকজন মাত্রেই জানেন। কিন্তু প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। তাঁদের মতে, এই চক্রে যেমন আছেন শাসকদলের নেতারা, তেমনই বন দফতর থেকে পুলিশ-প্রশাসন, বাকি নেই কেউ-ই।
অথচ প্রশাসনের শীর্ষস্তর থেকে নিয়মিত কড়া বার্তাই আসে। সম্প্রতি মেদিনীপুরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছেন, তিনি পুলিশ এবং বন দফতরকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটা গোটা রাজ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘বন দফতর, পুলিশ-প্রশাসন, সকলেই নজরদারি শুরু করেছে। চক্রের সঙ্গে যে-ই যুক্ত থাকুন, সে যত বড় নেতাই হোন না কেন, সকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
এই চক্রের শিকড় এলাকাভিত্তিতে কতটা গভীরে, বোঝা যায় যখন আলিপুরদুয়ারে গ্রেফতার হন তৃণমূল নেতা পাসাং লামা। কালচিনির এই নেতা বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছিলেন। কিন্তু কখন তাঁকে ধরা হল? যখন মুখ্যমন্ত্রী নিজে প্রকাশ্য প্রশাসনিক বৈঠকে আলিপুরদুয়ারের পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিলেন, ‘‘এক জন সব ‘হেরিটেজ’ বিক্রি করে দিচ্ছে। ওকে গ্রেফতার করুন।’’ তার পরেও তিন দিন পুলিশের সঙ্গে ‘লুকোচুরি খেলেছিলেন’ পাসাং।
দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরে জঙ্গল এলাকা অনেক বেশি। তাই এই চক্রের জাল ছড়িয়ে পাহাড় থেকে শুরু করে জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার জেলা পর্যন্ত। উত্তর দিনাজপুরের জঙ্গল এলাকাও এমন চক্রের হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। দক্ষিণবঙ্গে এই চক্রের অন্যতম বড় ঘাঁটি হলদিয়া মহকুমা এলাকায় নয়াচর। ভ্যানামেই চিংড়ির ভেড়ি তৈরির দোহাই দিয়ে এই এলাকায় ম্যানগ্রোভ কাটা হয়েছে এবং হচ্ছে। শুরুটা হয়েছিল বাম আমলে। প্রভাবশালী সিপিএম নেতাদের বিরুদ্ধে সরকারি জায়গা দখল করে ভেড়ি করার অভিযোগ রয়েছে এখানে। পরে তৃণমূলের ছত্রচ্ছায়ায় তা ফুলে ফেঁপে ওঠে।
পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রামেও বেআইনি ভাবে গাছ কাটার রমরমা চলেছে অনেক দিন ধরে। ঠিক যে ভাবে হুগলির বলাগড়ে রাতের অন্ধকারে গঙ্গায় ট্রলারে করে এসে আকাশমণি, অর্জুন, মেহগনির মতো দামী গাছ থেকে সাফ করে দেওয়া হয়েছে। মুর্শিদাবাদের ডোমকল জুড়েও চলে এমন গাছ কাটা।
কারা রয়েছে এর পিছনে? কত টাকারই বা লেনদেন হয়ে থাকে বছরভর?
প্রশাসনিক সূত্রে বলা হচ্ছে, শুধু উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জঙ্গল থেকেই বছরে ৫০ কোটি টাকার গাছ কেটে পাচার করা হয়। দক্ষিণের হলদিয়ায় আমপানের সময়ে কয়েক কোটি টাকার গাছ পাচার হয়েছে। হলদিয়া শিল্পতালুক, বালুঘাটার ঝাউ জঙ্গল, রায়রায়াচকের মতো এলাকায় নিত্য গাছ কাটা হয়। পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম এলাকায় বছরে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়। মুর্শিদাবাদে আবার এই বেআইনি গাছ চক্র নিয়ন্ত্রণ করে মাটি মাফিয়ারা। তাদের হাতেও বছরে কোটি টাকার গাছ কাটা পড়ে।
সব ক্ষেত্রেই আঙুল উঠেছে শাসকদলের স্থানীয় নেতাদের দিকে। তাঁদের সঙ্গে প্রশাসনের একাংশ, বন দফতরের লোকজনও যুক্ত থাকে বলে অভিযোগ। সব থেকে বড় কথা, বহু এলাকাতেই কেউ অভিযোগ জানাতে সাহস পায় না। সেটা যেমন হলদিয়ার ক্ষেত্রে সত্যি, তেমনই উত্তরবঙ্গেও। এর কারণ, গাছ কেটে পাচারে শাস্তি খুব কঠোর নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দু’বছরের জেল এবং সর্বোচ্চ দশ হাজার টাকা জরিমানা। উত্তরে এ পর্যন্ত খুব বেশি হলে শ’পাঁচেক লোকের জেল-জরিমানা হয়েছে। দক্ষিণে এই সংখ্যা আরও অনেক কম। কলকাতায় ২০২১-২০২২ সালে জরিমানা বাবদ জমা পড়েছে মোটে ৩৫ হাজার টাকা।
প্রশাসনেরই একটি সূত্রে বলা হয়েছে, একে তো শাসকদলের যোগ থাকায় বহু ক্ষেত্রেই পুলিশ-প্রশাসন চুপ করে থাকে বলে অভিযোগ। তার উপরে শাস্তির পরিমাণও কম। তা হলে গাছ কাটা আটকাবে কী করে? নবান্নের নির্দেশই বা কতটা পালন করা সম্ভব? রাজ্যে এক জন পাসাং লামার জেল হলেই কি সমস্যা মিটবে?
(চলবে)