কোথাও চাপে পড়ে তাঁরা ‘সঠিক রিপোর্ট’ দেননি। কোথাও আবার ‘সঠিক রিপোর্ট’ পাঠালেও তা নির্বাচন কমিশনের দরজায় পৌঁছনোর আগেই বদলে গিয়েছে তার বয়ান। শনিবার রাজ্যের ৯১টি পুরসভার ভোটের পরে প্রিসাইডিং অফিসারদের দেওয়া রিপোর্ট ঘিরে এমন অভিযোগ উঠেছে ভূরি ভূরি। শুধু তা-ই নয়, বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে প্রাথমিক ভাবে ৫২টি বুথে পুনর্নির্বাচন করানোর কথা ভেবেছিল নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তার সঙ্গে এক মত হননি রিটার্নিং অফিসারেরা। ফলে শেষ পর্যন্ত ৩৬টি বুথে ফের ভোট হয়। যার বেশ কয়েকটি আবার কমিশনের তালিকাতেই ছিল না।
এ সবের পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলগুলির দাবি, ভোট চলাকালীন জোর জবরদস্তির পাশাপাশি তার পরবর্তী প্রক্রিয়াতেও কারচুপি করে গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে। তৃণমূলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে ঘনিষ্ঠ মহলে শাসকদলের নেতাদের বক্তব্য, এই ধরনের অভিযোগ হাস্যকর।
ভোটপ্রক্রিয়া পরিচালনা করার জন্য প্রতি বুথে এক জন করে প্রিসাইডিং অফিসার নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশন। দিনভর কেমন ভোট হল, সে ব্যাপারে তাঁর রিপোর্ট দেওয়ার কথা। প্রিসাইডিং অফিসার রিপোর্ট জমা দেন জেলার রিটার্নিং অফিসারকে। তিনি এই সব রিপোর্টের নির্যাস তৈরি করে জমা দেন নির্বাচন কমিশনে। কলকাতার পুরভোটের দিন ‘পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়’ বলে মন্তব্য করেও শেষ পর্যন্ত কোনও বুথে পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেননি রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায়। কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্টে কোনও গোলমালের কথা বলা হয়নি।
গত শনিবারও রাজ্যের অন্যত্র যে মাপে ভোট-কারচুপি, ছাপ্পা ও সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে, সেই তুলনায় পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ দেয়নি নির্বাচন কমিশন। এমনকী বিরোধীদের অভিযোগ, তারা যে সব জায়গায় গোলমালের কথা বলেছিল সেই সব জায়গার বদলে তুলনায় শান্ত এলাকায় ফের ভোট করানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, এর পিছনেও কারণ সেই কমিশনের হাতে পৌঁছনো রিপোর্ট।
সেই রিপোর্টের ভিত্তি কী?
বর্ধমান জেলার এক প্রিসাইডিং অফিসার বলেন, ‘‘ভোটের আগের রাতে ভোটকেন্দ্রে পৌঁছনোর পরেই শাসকদলের স্থানীয় নেতারা এসে বাড়ির ঠিকানা, কোন অফিসে কাজ করি, বাড়ির লোকেদের নাম— সব লিখে নিয়ে যান। সকালে কোনও গণ্ডগোল হলে চুপ করে থাকার চাপা শাসানিও দেওয়া হয়েছিল। এর পরে আর রিটার্নিং অফিসারকে দেওয়া রিপোর্টে সত্যি কথা লেখার সাহস হয়নি।’’ কাটোয়ার একটি বুথের প্রিসাইডিং অফিসারের কথায়, ‘‘প্রথমেই বুথের চার পাশে বোমা-গুলি পড়তে থাকে। তার পর এক জন ভিতরে ঢুকে আমার বুকে বন্দুক ধরে। ইভিএমের কন্ট্রোল ইউনিট টেনে নিয়ে ভোট দিতে থাকে। আমি এ সব কথা রিপোর্টে লিখিনি। এলাকাতেই থাকি। কী করে লিখব!’’
খড়্গপুরে ভোটের দুপুরে ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের বিশ্বরঞ্জন নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২১৬ নম্বর বুথের সামনে শূন্যে গুলি চলার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পরে ওই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার নিতাই ভট্টচার্য সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছিলেন, “জনা তিনেক লোক মুখে কালো কাপড় বেঁধে এসে বলে, ‘আমরাই ভোটটা করাব’। আমি রাজি হইনি। সেই মুহূর্তে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দিই। ওরা চলে যায়। পরে বাইরে একটি গুলির শব্দ শুনি।’’ গোলমালের খবর পেয়ে সেখানে গিয়ে জেলার পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ দাবি করেন, কোনও বুথ দখল হয়নি, গুলিও চলেনি। প্রিসাইডিং অফিসার এর পর আর রা কাড়েননি। এমনকী, তাঁর রিপোর্টেও কিছু লেখেননি।
তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকারি কর্মীদের সংগঠনের এক নেতা জানাচ্ছেন, প্রিসাইডিং অফিসারদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিসিভিং সেন্টারে (বুথ থেকে ফিরে যেখানে ভোট-যন্ত্র জমা দেওয়া হয়) এসে রিপোর্ট লেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেখানে পদস্থ নির্বাচন আধিকারিকদের সামনে, তাঁদের নির্দেশ অনুযায়ী, রিপোর্ট লিখতে বাধ্য করা হয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রিসাইডিং অফিসারকে। কর্তাদের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় কেউ অন্যথা করেননি।
যাঁরা এই চাপ উপেক্ষা করেছেন, তাঁদের রিপোর্ট পাল্টে দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ। হুগলির এক প্রিসাইডিং অফিসারের কথায়, ‘‘আমার বুথে ঢুকে শাসকদলের লোকজন বিরোধী সব এজেন্টকে বের দেয়। তার পরে জাল ভোট দেওয়া শুরু করে। আমি রিপোর্টে জানিয়েছিলাম, যে সময়ে বেশি ভোট পড়েছে তার আসল কারণ কী। পরে শুনেছি, আমার সই-সহ ওই রিপোর্ট বদল করে দেওয়া হয়েছে।’’
বসিরহাটের এক প্রিসাইডিং অফিসারের অভিজ্ঞতা, ‘‘বহিরাগত কিছু যুবক বুথে ঢুকেছে দেখেও বন্দুকধারী পুলিশ প্রতিরোধ করল না। বিরোধী দলের এজেন্টদের আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে বুথ থেকে বের করে দিল ওরা। আমাকে হুকুম করা হল, ‘‘চুপচাপ বসে থাকুন স্যার। আপনার কোনও অসুবিধা হবে না।’’ মিনিট পনেরোর মধ্যে অন্তত শ’দেড়েক ছাপ্পা ভোট দিয়ে দিল ওরা। এ সব কথাই আমি রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, পুনর্নির্বাচনের তালিকায় সেই বুথের উল্লেখ নেই।’’
এখানেই এক তরুণ প্রিসাইডিং অফিসারের অভিজ্ঞতা, ‘‘মিষ্টি মুখে কিছু ছেলে বলল, জাস্ট মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন। কোনও গোলমাল হবে না। বাস্তবিক হলও তাই। আধ ঘণ্টা বুথের সামনে জটলা করে লাইনের গতি কমিয়ে দিল ওরা। ভিতরে তিন-চার জন ঢুকে একের পর এক ছাপ্পা ভোট করে গেল। এ সব রিপোর্টে লিখলেও ফের ভোট হল না তো!’’
কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়ারও অভিযোগ, বধর্মানের কাটোয়া বা পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, চন্দ্রকোনায় বেশ কিছু বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের দেওয়া তথ্য রিটার্নিং অফিসার স্তরে খারিজ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর দাবি, ‘‘কিন্তু সত্যনিষ্ঠ থাকতে চাইলে প্রিসাই়ডিং অফিসারা কমিশনে নিজেদের বক্তব্য ‘নোট’ করে পাঠাতে পারেন।’’
বসিরহাটের বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘প্রিসাইডিং অফিসার বাস্তবে যা ঘটেছে, তা-ই লিখেছেন। কিন্তু রিটার্নিং অফিসারের কাছে গিয়ে সে সব পাল্টে যাচ্ছে! প্রিসাইডিং অফিসারদের দেওয়া রিপোর্ট কি তবে বদল করা হয়েছে?’’ বসিরহাটের মহকুমাশাসক শেখর সেন অবশ্য বলেন, ‘‘প্রিসাইডিং অফিসারদের রিপোর্ট খতিয়ে দেখেছেন পর্যবেক্ষকেরা। রাজনৈতিক দলের অভিযোগও খতিয়ে দেখছেন তাঁরা। এর পরেই যাবতীয় রিপোর্ট নির্বাচন কমিশনের কাছে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট বদলের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, শনিবারের ভোটের পর বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ পেয়ে মোট ৫২টি বুথে পুনর্নির্বাচনের কথা বলে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারদের কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান তাঁরা। শেষ পর্যন্ত ৩৬টি বুথে গোলমালের কথা স্বীকার করেন অফিসারেরা। কিন্তু সেই বুথগুলির অনেক ক’টির সঙ্গে কমিশনের তালিকার মিল নেই। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীন দেবের অভিযোগ, ‘‘যে সব বুথে বিরোধীরা পুনর্নির্বাচন চেয়েছিল,বেশির ভাগ জায়গাতেই কমিশন ভোট করার নির্দেশ দেয়নি। বরং, যেখানে কোনও অভিযোগ নেই, সেখানে ফের ভোট হয়েছে! বাস্তবের সঙ্গে কমিশনের সিদ্ধান্ত মিলছে না, রিটার্নিং অফিসাররা ঠিক রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন না বলেই।’’
কিন্তু রিটার্নিং অফিসারের রিপোর্ট যা-ই হোক, বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে রাজ্য নির্বাচন কমিশনার কেন কোনও ব্যবস্থা নিলেন না? সুশান্তবাবুর বক্তব্য, আইন তাঁর হাত-পা বেঁধে রেখেছে। পুর নির্বাচন সংক্রান্ত আইনের ৬২ এবং ৬৩ নম্বর ধারায় কোন পরিস্থিতিতে পুর্ননির্বাচন হবে তা বলা আছে। ফলে রিটার্নিং অফিসারেরা যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তার ভিত্তিতেই ফের ভোট হচ্ছে।
বিরোধী দলগুলি তো বটেই, প্রশাসনের একাংশও সুশান্তবাবুর এই যুক্তি মানতে নারাজ। নবান্নের এক কর্তা জানান, গত পঞ্চায়েত ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনার রিটার্নিং অফিসার কোনও বুথে পুনর্নির্বাচনে রাজি ছিলেন না। কিন্তু তৎকালীন রাজ্য নির্বাচন কমিশনার মীরা পাণ্ডে একতরফা ২০টি বুথে পুর্ননির্বাচন ঘোষণা করেছিলেন। ওই কর্তার কথায়, ‘‘রাজ্য সরকারের আইনে কমিশনের ক্ষমতা নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই ঠিকই। কিন্তু সংবিধানের ২৪৩কে ধারায় ভোট পরিচালনার যাবতীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ভারতের নির্বাচন কমিশনকে। এবং এই ধারা রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। চাইলে এই ধারাতেই সুশান্তবাবু তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন।’’
কিন্তু ঘটনা হল, রাজ্য সরকারের সঙ্গে তিনি যে কোনও সংঘাতে যাবেন না, তা আগেই জানিয়ে রেখেছেন সুশান্তবাবু। অনেকের মতে, রাজ্য সরকার পরিকল্পিত ভাবেই নির্বাচন কমিশনার পদের অবনমন ঘটিয়েছেন। যাতে মীরা পাণ্ডের বিদ্রোহের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। এত দিন পর্যন্ত কমিশনার পদে আইএএস অফিসারদের নিয়োগ করা হতো। কিন্তু সুশান্তবাবু ডব্লুউবিসিএস। অথচ প্রশাসনের যাঁদের সঙ্গে তাঁকে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করতে হয়, তাঁরা প্রায় সকলেই আইএএস। পদমর্যাদায় ফারাকের কারণে প্রশাসনিক কর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় না বলেই নবান্নের বহু আধিকারিকের মত।
কমিশনারের কর্তৃত্ব আরও খর্ব করতে এক জন উপদেষ্টাও নিয়োগ করেছে রাজ্য। সেই উপদেষ্টা গুরুপদ কোনার সোমবার সন্ধ্যায় সুশান্তবাবু যখন সাংবাদিক বৈঠক করছেন তখন তাঁকে ফোন করে জানতে চান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে কেন তিনি রাজ্য পুলিশের ডিজি-র কাছ থেকে রিপোর্ট চেয়েছেন। কমিশনার তাঁকে বলেন, ৯১টি পুরসভায় ভোটের দিন ও তার আগের দিন কোথায়, কত গুলি চলেছে, বোমা ফেটেছে, কত জন মারা গিয়েছেন, কত জন আহত— কমিশনের কাছে সেই তথ্য থাকা প্রয়োজন। কমিশন সূত্রে খবর, সুশান্তবাবুর এমন রিপোর্ট চাওয়ার এক্তিয়ার আছে কি না সেই প্রশ্ন তোলেন গুরুপদবাবু। কমিশনার তাঁকে বলেন, তবে কি পুলিশ যাতে সন্তুষ্ট হয় এমন রিপোর্টই চাইবে কমিশন? তিনি তো পুলিশকে ‘ডাইরেক্ট’ করছেন না (নির্দেশ দিচ্ছেন না)।
এর পরে কথাবার্তা আর বিশেষ এগোয়নি। তবে কমিশনের করুণ দশা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তত ক্ষণে।