বাঁশ ও কাছি দিয়ে বাঁধা হচ্ছে ঘরের চাল। নিজস্ব চিত্র।
ভাঙা টিনের শেড, উপড়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ি এখনও পড়ে আছে রাস্তার ধারে। কাকদ্বীপের রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে বিডিও অফিসের দিকে। ঠিক এক বছর আগের স্মৃতি চোখের সামনে ভাসছে। আমপানের ক্ষত এখনও দগদগে। তার মধ্যেই ইয়াসের ভ্রূকুটি।
ঘূর্ণিঝড় চলাকালীন উপকূল এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখতে আমরা, হ্যাম রেডিয়োর কুইক রেসপন্স টিমের ১৫ জন সদস্য দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনের ডাকে সোমবার সকালেই পৌঁছে গিয়েছি কাকদ্বীপ, গঙ্গাসাগর, মৌসুনি আইল্যান্ড, জি প্লট ও ঘোড়ামারায়। আমপানের সময়েও একই ভাবে কাজ করেছিলাম। এ বারও কাকদ্বীপে বেস স্টেশনের দায়িত্বে রয়েছি আমি এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল রেডিয়ো ক্লাবের সেক্রেটারি অম্বরীশ নাগবিশ্বাস, শ্রয়ন মণ্ডল, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তীরা। ওঁদের মধ্যে ঘূর্ণিঝড়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই প্রথম হবে কলেজ ছাত্র শ্রয়নের। অন্য স্টেশনগুলিতেও যাঁরা আছেন, সকলেই অভিজ্ঞ। আয়লা থেকে আমপানের মতো সুপার সাইক্লোনে রীতিমতো জীবন বাজি রেখে কাজ করেছেন সকলেই।
আটটা নাগাদ যখন বিডিও অফিস লাগোয়া এসডিএলআরও অফিসের পাঁচতলার ছাদে চিলেকোঠার মাথায় উঠে ভিএইচএফ (ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি) এবং এইচএফ (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) অ্যান্টেনা বানাচ্ছি আমরা, তখন ঠা-ঠা রোদ। ঘাম ঝরছে দরদর করে, গাছের পাতাও স্থির। আমপানের সময়েও ঠিক এই ছাদেই একই ভাবে অ্যান্টেনা তৈরি করে বাঁশ ঠেকিয়ে যখন সেটি তোলা হচ্ছিল, চার পাশ ছিল এমনই গুমোট। তা হলে কি ঝড়ের সময় এগিয়ে এল? হ্যাম স্যাটেলাইট আপডেট অন্তত তেমন কোনও পূর্বাভাস দিল না।
আমপানের দিন আমাদের অ্যান্টেনাও সোজা থাকছিল না। প্রবল ঝড়ের মধ্যেই আমরা সেটি ঠিক করতে এই ছাদে উঠেছিলাম। এই এলাকায় টিনের ছাউনির বাড়ির সংখ্যা প্রচুর। পাশের ছাদের টিনের শেডটা প্রবল বেগে দুলছিল। আচমকা একটা আওয়াজ হয়ে কাটা ঘুড়ির মতো ঢেউ খেলে সেটি উড়ে এল। সবাই ভয়ে উবু হয়ে বসে পড়েছিলাম। মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া সেই টিন গিয়ে পড়ল পাশের পুকুরে। কোনও রকমে দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম, বিশ্বকর্মা বা সরস্বতী পুজোর সময়ে যেমন আকাশে ঘুড়ি ওড়ে, তেমনই টিনের শেড উড়ছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে বিভিন্ন জায়গায়।
এ বার তাই বোধহয় আগাম সতর্কতা আশপাশের বাড়িগুলিতে। অনেককেই দেখলাম, টিনের উপরে লোহার পাত নাট-বল্টু দিয়ে আটকেছেন। কেউ আবার শেষ মুহূর্তে চাল বাঁচাতে ছাউনির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধছেন কাঠ আর বাঁশ। যাতে হাওয়ার দাপটে ছাউনি উড়ে না যায়।
বেস স্টেশন চালু হতেই এ দিন প্রথম আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল জি প্লটের স্টেশনটি। সেখানে তখন আকাশে মেঘ। এক-এক করে অন্য স্টেশনগুলির সঙ্গে যোগাযোগ হল। কথা হল কলকাতার কন্ট্রোল রুমের সঙ্গেও। এইচএফ রেডিয়োয় আমরা দেশ ও বিদেশের বেশ কিছু স্টেশনকেও আপডেট দিলাম। এরই মধ্যে খবর এল, ঘোড়ামারায় বাঁধ ভেঙেছে। বেশ কিছু মানুষকে কাকদ্বীপে বিবেকানন্দ স্কুলের ফ্লাড সেন্টারে আনা হয় নৌকা করে।
তবে এ বার প্রশাসনিক প্রস্তুতি অনেকটাই বেশি নজরে পড়ল। করোনার ভীতি আমপানের সময়েও ছিল। কিন্তু, মাস্ক পরার প্রবণতা কম ছিল। এ বার উল্টোটা। রাস্তাঘাট এমনিতে ফাঁকা। যাঁরা বেরিয়েছেন, সবার মুখে মাস্ক। ঠিক তেমনই ইয়াস নিয়েও ভীতি কাজ করলেও সতর্কতা সাধারণ মানুষের মধ্যেও নজরে পড়ার মতো। এখন অপেক্ষা, এই ঝিরঝিরে বৃষ্টি আর হাল্কা হাওয়া কখন ভয়াল রূপ নেবে।
(লেখক হ্যাম রেডিয়ো স্বেচ্ছাসেবক)