বৃষ্টিমেখে অশ্ববিলাসে
চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে বদলে গেল আকাশের ছবি!
শুক্রবার দুপুরেও ভ্যাপসা গরমে ঘেমেনেয়ে নাকাল হয়েছেন কলকাতাবাসী। আর শনিবার দুপুরে মেঘের ঘনঘটা। মেঘ-বৃষ্টির সঙ্গে কোথাও কোথাও বাজও পড়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, মধ্যমগ্রামের মিলনপল্লিতে বাবা, মা, ভাইয়ের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য বাড়ির ছাদে উঠেছিলেন আসিফ আলি (২১) নামে এক তরুণ। তখনই বাজ পড়ে মারা যান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রটি।
এমন বৃষ্টি দেখে এ দিন বিকেলে আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানায়, এই বৃষ্টি বর্ষার আগমনী শোনাচ্ছে। একে প্রাক-বর্ষার বৃষ্টি বলেই দাবি করেছেন আবহবিদেরা। তাঁদের পূর্বাভাস, বর্ষা দক্ষিণবঙ্গের দরজায় কড়া নাড়ছে এবং তাকে টেনে এনেছে ওড়িশা উপকূলের একটি ঘূর্ণাবর্ত।
আবহাওয়া অফিস জানায়, বৃহস্পতিবার জোরালো কালবৈশাখীর হাত ধরে গাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রচুর জলীয় বাষ্প ঢুকে পড়ে। সেই মেঘপুঞ্জে জলকণার পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ঘূর্ণাবর্তটি। তাই শনিবার থেকেই কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকায় বর্ষার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ঘনঘন মেঘ ডাকছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। দফায় দফায় বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির রেশ থাকছে সারাদিন। আবহবিদদের ভাষায়, এটা ‘আদর্শ বর্ষার পরিবেশ’।
জমা জল সরলো নিমেষে। সৌজন্যে সারমেয়। জমা জলের জায়গায় মুখ দিয়ে খুঁড়ে গর্ত করে দেয় কুকুরটি।
তার পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যেই নেমে যায় জল। শনিবার সল্টলেকের করুণাময়ীতে। ছবি: শৌভিক দে।
এমন পরিবেশ দেখে শনিবার দিনভর উপগ্রহ চিত্রে চোখ রেখে বসেছিলেন আবহবিদেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, ওড়িশা উপকূলে থাকা ঘূর্ণাবর্তটির কেন্দ্রস্থলে বায়ুর গতি যত বাড়ছে, ততই একটু করে পশ্চিম ও মধ্য ভারতের উপরে চেপে বসা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু তার গতিমুখ বদল করছে। তাতেই ভাগ্য ফিরছে দক্ষিণবঙ্গের। বর্ষার আশায় মুখে হাসি ফুটেছে হাওয়া অফিসের আপাতগম্ভীর বিজ্ঞানীদেরও। এ দিন বিকেলে আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘‘দেখি রবিবার কোনও সুখবর দিতে পারি কি না!’’ এ দিনই দার্জিলিং-সহ উত্তরবঙ্গে বর্ষা ঢোকার কথা জানান তিনি।
স্বাভাবিক নিয়মে কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা আসার কথা ৮ জুন। তার দু’দিন আগে-পরে বর্ষা এলেও তাকে স্বাভাবিক বলেই ধরেন আবহবিদেরা। কিন্তু জুন মাসের ১০ তারিখ পেরিয়ে গেলেই কপালে ভাঁজ পড়ে কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতর (মৌসম ভবন)-এর বিজ্ঞানীদের। এক আবহবিদের ব্যাখ্যা, নির্দিষ্ট সময় থেকে বর্ষার আগমন যত পিছোতে থাকে, ততই সমস্যা তৈরি হয়। কারণ বর্ষার সঠিক সময়ে আসা এবং তার সঠিক ছন্দে থাকার উপরে কৃষির ভাগ্য পুরোপুরি নির্ভরশীল। ‘‘এ বার সারা দেশে বর্ষার ঘাটতির পূর্বাভাস রয়েছে। তাই বর্ষার সঠিক সময়ে আসাটা জরুরি ছিল’’, বলছেন ওই আবহবিদ। তিনিই মনে করাচ্ছেন, রবিবার অর্থাৎ ১৪ জুন বর্ষা এলেও তা কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের ছ’দিন পরে দক্ষিণবঙ্গে ঢুকবে।
আবহাওয়া দফতর সূত্রের খবর, প্রশান্ত মহাসাগরের জলের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি রয়েছে। যাকে ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি বলা হয়। তার ফলে মৌসুমি বায়ু কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। নির্ঘণ্ট মেনে এ বার কেরলেও আসেনি সে। কেরল দিয়ে মূল ভূখণ্ডে ঢোকার পরেই গত সোমবার আরব সাগরে একটি ঘূর্ণিঝড় তৈরি হয়। শ্রীলঙ্কা যার নাম দিয়েছিল আশোবা। তার ফলে পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতেই বর্ষা আটকে ছিল। দক্ষিণবঙ্গে বর্ষা কবে ঢুকবে, নিশ্চিত করে বলতে পারছিল না আবহাওয়া দফতর।
তা হলে এক সপ্তাহ কাটতে না-কাটতেই পরিস্থিতি বদলে গেল কী করে? আবহবিদদের ব্যাখ্যা, আশোবা ওমান উপকূলে আছড়ে পড়ায় মৌসুমি বায়ুর উপরে তার যে প্রভাব ছিল, সেটাও কেটে গিয়েছে। উপরন্তু ওড়িশা উপকূলে তৈরি হয়েছে একটি ঘূর্ণাবর্ত। সেটি মৌসুমি বায়ুকে পূর্ব ভারতের দিকে এনেছে। তাতে শুধু কলকাতার বাসিন্দারা নন, স্বস্তি পেয়েছেন আবহবিদেরাও। তাঁদের এক জনের কথায়, ‘‘ওড়িশা উপকূলে তৈরি হওয়া ঘূর্ণাবর্তটি আমাদের মান বাঁচাল।’’
তবে এই স্বস্তির আবহাওয়াতেও সিঁদুরে মেঘ দেখছেন আবহবিদদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, ‘এল নিনো’ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় বর্ষা এ বার দুর্বল থাকবে। তাই দক্ষিণবঙ্গে ঢুকলেও কত দিন তার মেজাজ চড়া থাকবে, তা নিয়ে সন্দিহান তাঁরা।