অভাবী মা-বাবার লড়াই শক্তি দিয়েছে শ্বেতাকে

বাবার ছোট্ট মুদির দোকানের আয়ে সংসারে এদিক টানতে ওদিক কুলোতো না। ছোট থেকেই দেখেছে ওই অভাবের মধ্যেও তাঁর প়ড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়ের লড়াই। বাবা-মার সেই লড়াই ছুঁয়েছিল একরত্তি মেয়েটাকে।

Advertisement

তাপস ঘোষ

ভদ্রেশ্বর শেষ আপডেট: ১২ মে ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

বাবা-মায়ের সঙ্গে শ্বেতা অগ্রবাল। নিজস্ব চিত্র।

বাবার ছোট্ট মুদির দোকানের আয়ে সংসারে এদিক টানতে ওদিক কুলোতো না। ছোট থেকেই দেখেছে ওই অভাবের মধ্যেও তাঁর প়ড়াশোনা নিয়ে বাবা-মায়ের লড়াই। বাবা-মার সেই লড়াই ছুঁয়েছিল একরত্তি মেয়েটাকে। শক্তি জুগিয়েছিল দাঁতে দাঁত চেপে অভাব, কষ্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার। প্রত্যয় ছিল, মা-বাবার মুখে হাসি ফেরাবেন তিনি।

Advertisement

মঙ্গলবার যখন সবাই জেনে গিয়েছে, ইউপিএসসি পরীক্ষায় হুগলির ভদ্রেশ্বরের মেয়ে ২৯ বছরের শ্বেতা অগ্রবাল দেশের মধ্যে ১৯ তম স্থান পেয়েছেন তখন অনেক কষ্টে ফোনে হায়দরাবাদে ধরা গেল তাঁকে। ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে এল উচ্ছ্বসিত গলা, ‘‘আমার এই সাফল্য বাবা-মাকে উৎসর্গ করলাম। ওঁদের জন্যই আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছেছি।’’

ভদ্রেশ্বরের রবীন্দ্রনগর জিটি রোডের বাসিন্দা সন্তোষ এবং প্রেমা অগ্রবালের একমাত্র মেয়ে শ্বেতা। পৈতৃক মুদির দোকান থেকে যা আয় তা দিয়ে সংসার চালানোই দায়। অভাব নিত্যসঙ্গী হলেও মেয়ের পড়াশোনায় তার থাবা বসতে দেননি সন্তোষবাবু। নিজে বারো ক্লাসের পর পড়ায় ইতি টেনেছেন। স্ত্রী প্রেমা মাধ্যমিক পাশও নন। তাই মেয়েকে ঘিরেই যাবতীয় স্বপ্ন দু’জনের।

Advertisement

বাবা-মায়ের লড়াই ছুঁয়েছিল একরত্তি মেয়েটাকে। তাই ছোট থেকেই অভাব, কষ্টকে সঙ্গী করে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছে সে। পড়াশোনাই ছিল ধ্যানজ্ঞান। চন্দননগরের সেন্ট জোসেফ কনভেন্ট থেকে মাধ্যমিক। তারপর ব্যান্ডেলের অক্সিলিয়াম কনভেন্ট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে স্নাতক। সংসারে অর্থাভাব থাকলেও প্রত্যেক পরীক্ষায় শ্বেতার নম্বরের অভাব ছিল না। সবেতেই ৯০ শতাংশের উপর।

দেশের হয়ে কিছু করতে পারার টান শ্বেতার ছোট থেকেই। কলেজের পড়ার খরচ কোনওমতে সামলান বাবা। এর উপর আবার উচ্চ শিক্ষার খরচ? মেয়েকে অভয় দিয়ে কোনওদিকে না তাকিয়ে এগিয়ে যেতে বলেছিলেন বাবা-মা। পারিবারিক বন্ধু হিসাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মহম্মদ ইসলাম উদ্দিন। মেয়ের পড়ার বিপুল খরচ জোগাতে মুদিখানার ব্যবসা ছেড়ে লোহার ব্যবসা ধরেন। সাহায্য পেয়েছেন চন্দননগরের বাসিন্দা বিজয় গুহ মল্লিক এবং কৃষ্ণচন্দ্র মণ্ডলের। এরই মধ্যে মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরির সুযোগ আসে শ্বেতার। সংসারে টাকার প্রয়োজনের কথা ভেবে চাকরিতে যোগ দেন শ্বেতা। বছর ঘুরতে না ঘুরতে ইস্তফা চাকরিতে এবং ইউপিএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু।

২০১৩-’১৪ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে ছিলেন ৪৯৭ নম্বরে। দমে যাননি শ্বেতা। ২০১৪-’১৫ সালে ফের সিভিল সার্ভিসে বসলেও আইএএস-এ সুযোগ পাননি। ১৪১ নম্বরে থাকা শ্বেতা সুযোগ পান আইপিএস-এ। এখন হায়দরাবাদে। সেখানে পুলিশ অ্যাকাডেমিতে চলছে প্রশিক্ষণ। এ সবেরই মধ্যেই আবার ২০১৫-’১৬ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসেন। গত মঙ্গলবার ফল প্রকাশের পর দেখা গেল দেশের মধ্যে ১৯ নম্বরে নাম শ্বেতার। অবশেষে আইএএস হওয়ার স্বপ্ন সফল। তারপর টানা দু’দিন ধরে শুধুই অভিনন্দনের বন্যা। মেয়ে এখানে নেই। তাতে কী, এমন মেয়ের বাবা-মাকে দেখতেই ভিড় করছেন প্রতিবেশীরা।

বুধবার নিজের দোকানে বসে মেয়ের সাফল্যের কথা বলার সময় চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না সন্তোষবাবু। বললেন, ‘‘সে সব দিনের কথা কোনওদিন ভুলব না। টাকার অভাবে একটা টিভি পর্যন্ত ছিল না বাড়িতে। তাই মেয়ে একদিন পাশের বাড়িতে টিভি দেখতে গিয়েছিল বলে খুব বকাঝকা করেছিলাম। কোনও অনুযোগ করেনি। শুধু সেই থেকে টিভি দেখাই প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। অথচ আজ ওর খবরই সবাই টিভিতে দেখছে।’’ মা প্রেমাদেবীর কথায়, ‘‘মেয়েই আমাদের সব। অনেক অভাব-অনটনের মধ্যেও যে ভাবে ও সফল হয়েছে তা আমাদের গর্ব।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement