দূষিত: বাঁশবেড়িয়া শহরের নর্দমার জল এসে পড়ছে গঙ্গায়।
পরিকল্পনা হয়েছে বিস্তর। কিন্তু কাজ এগোয়নি তেমন। তার ফলে দূষণও কমেনি গঙ্গার। কারখানার বর্জ্য থেকে রাস্তার আবর্জনা— সবই মিশছে গঙ্গার জলে। পাড়ে জমছে প্লাস্টিক-সহ অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ। শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়ার মতো শহরে আবাসনের বা অন্য প্রকল্পের চৌহদ্দি ঢুকে পড়ছে গঙ্গার সীমানায়। গঙ্গার উপরেই গেঁথে দেওয়া হয়েছে নির্মাণ।
কেন্দ্রের বর্তমান সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে গঙ্গা সাফাইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এক সময়। সাড়ম্বরে ‘নমামি গঙ্গে’ প্রকল্প শুরু হয়। গঙ্গার হাল ফেরাতে কোটি কোটি টাকা মঞ্জুর হয়। বছর খানেক আগে গঙ্গা সাফাই কর্মসূচিতে সপার্ষদ হুগলিতে আসেন সংশ্লিষ্ট দফতরের তৎকালীন মন্ত্রী উমা ভারতী। দাবি করেন, ‘‘১০ বছরের মধ্যে গঙ্গা আমূল বদলে যাবে। চটজলদি প্রকল্পের কাজ হবে।’’ কিন্তু এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, তারপর থেকে কোনও কাজই চোখে পড়েনি।
পরিবেশবিদদের আক্ষেপ, শুধু কেন্দ্রীয় প্রকল্প নয়। গঙ্গা সংলগ্ন পুরসভাগুলিও হাত গুটিয়ে রয়েছে। ফলে গঙ্গা ক্রমশ নর্দমায় পরিণত হচ্ছে। অতিরিক্ত দূষণে গঙ্গার বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হচ্ছে। ভাল নেই জলজ প্রাণীও। কিছু দিন আগে শ্রীরামপুর এবং চন্দননগরে গঙ্গার পাড়ে তিনটি শুশুক মরে ভেসে ওঠে। ‘নির্মল জেলা’ হুগলিতে এখনও গঙ্গার পাড়ে মানুষজন প্রাতঃকৃত্য সারেন বলেও অভিযোগ।
রাজ্যের সেচমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্র অবশ্য দোষ চাপিয়েছেন কেন্দ্রের ঘা়ড়ে। তাঁর কথায়, ‘‘নমামি গঙ্গের প্রধান লক্ষ্যই ছিল গঙ্গার দূষণ রোধ। কিন্তু কেন্দ্রে প্রতিশ্রুতি আসলে স্লোগান সর্বস্ব কথায় পরিণত হয়েছে।’’
কচুরিপানায় ভরেছে গঙ্গা, বলাগড় ঘাটে।
কিন্তু রাজ্য কী করছে?
সেচ মন্ত্রীর জবাব, ‘‘রাজ্যে আমরা গঙ্গার ধারে ধারে সৌন্দর্যায়নের কাজ করছি। কিন্তু গঙ্গার দূষণ রোধের বিষয়টা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’’
কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ঠিক হয়েছিল, রাজ্যে রাজ্যে গঙ্গার ধারে নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত হবে। ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রা ধরে রেখে গঙ্গাকে বাঁচানো এবং একে দূষণমুক্ত রাখার জন্য ওই সব এলাকায় কোনও নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ জল তুলে ফেললে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, সেখানে অক্সিজেন প্রবেশ করে। তখন আর্সেনিকের মতো নানা খনিজ দ্রব্য জলে মিশে যায়। নদীর অববাহিকায় এই সমস্যা বেশি হয়।
অভিযোগ, ‘নদী সংরক্ষণ ক্ষেত্র’ (রিভার কনজার্ভেশন জোন) চিহ্নিত করার কাজই শুরু করতে পারেনি কেন্দ্র। আবার গঙ্গায় যাতে সরাসরি কঠিন বর্জ্য ও নিকাশি নালার জল এসে না পড়ে, তার জন্য নদীর ধারের জেলাগুলিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা হয়েছিল। সে দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। সে কাজও এগোয়নি বিন্দু মাত্র। সিএজি রিপোর্টে হুগলির বিভিন্ন শহরে গঙ্গার দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সম্প্রতি জাতীয় গ্রিন ট্রাইব্যুনালও গঙ্গা দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
পরিবেশবিদদের একাংশও দাবি করেছেন, গঙ্গা দূষণের জন্য বিভিন্ন কল-কারখানার এবং নদী তীরবর্তী পুরসভা বা পঞ্চায়েত তাদের দায় এড়াতে পারে না। হুগলির এক পরিবেশবিদের কথায়, ‘‘গঙ্গা পরিষ্কার করবে না, উল্টে নোংরা করবে! কেন্দ্র কী করবে? রাজ্যের হাতে যা আইন আছে, তা তো রাজ্যকেই কার্যকর করতে হবে।’’ তাঁর দাবি, ‘‘এর আগেও গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান হয়েছে, লাভ হয়নি। এলাকার বাসিন্দা থেকে রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীর মানসিকতা না বদলালে কিছুই হবে না।’’
চাঁপদানির এক প্রৌঢ় বলেন, ‘‘আমাদের এখানে এত কল-কারখানা, তার বর্জ্যে গঙ্গায় মারাত্মক দূষণ ছড়ায়। এই সব জায়গায় দূষণ রোধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’’
এই জেলায় এসে কেন্দ্রীয় গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ডের কর্তারা জানিয়েছিলেন, পান্ডুয়া এবং বলাগড়ে আর্সেনিক রোধের জন্য কয়েক কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এই টাকায় আর্সেনিকমুক্ত গভীর নলকূপ তৈরি করা হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, এ ব্যাপারেও তেমন পদক্ষেপ নেই। সম্প্রতি বলাগড় ব্লকে বেশ কয়েকটি নলকূপে আর্সেনিক মিলেছে। ওই সমস্ত নলকূপের জল ব্যবহারে প্রশাসনের তরফে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন আধিকারিক, পরিবেশবিদ বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘গঙ্গার অবস্থা ভয়াবহ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলি যতদিন পর্যন্ত সদিচ্ছা না দেখাবে, ততদিন কিচ্ছু হবে না।’’
ছবি: সুশান্ত সরকার